বাংলাদেশের অনলাইন রাজনীতিতে এখন খুব জনপ্রিয় একটি টার্ম হল’বট একাউন্ট’। সাধারণত ফেসবুকে কোন পরিচয় ছাড়া কিংবা প্রোফাইল পিকচার ছাড়া একাউন্টকে আমরা ‘বট একাউন্ট’ বলে থাকি।
যদিও ফেসবুক বট আইডি বলতে এমন এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় বা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা অ্যাকাউন্ট বোঝায়, যা সাধারণত কোনো ব্যক্তি পরিচালনা করে না, বরং একটি প্রোগ্রাম বা বট দ্বারা চালিত হয়।
এ ধরনের আইডিগুলো সাধারণত মার্কেটিং, ফেক ফলোয়ার, প্রোপাগান্ডা, ফিশিং , অটোমেটেড কাস্টমার সার্ভিসসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।
তবে আমরা দেখেছি যে, বাংলাদেশে এই মুহুর্তে বট আইডির চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে অ্যাস্ট্রোটার্ফিং অ্যাকাউন্ট। এই একাউন্টগুলো মানুষ দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে তবে তার সব ধরনের পরিচয় লুকিয়ে।
অ্যাস্ট্রোটার্ফিং হল একটি কৌশল, , যেখানে সাধারণ জনগণের মতামত বা জনসমর্থন জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়।অ্যাস্ট্রোটার্ফিং কৌশলের জন্য ব্যবহৃত একাউন্টগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
প্রথমেই আসে সোকপাপেট অ্যাকাউন্ট। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেকে গোপন রেখে ভিন্ন নামে পরিচিত হতে এই ধরনের অ্যাকাউন্ট তৈরি করে। প্রকৃত পরিচয় আড়াল রেখে নিজের বা নিজের দলের পক্ষে প্রচারণা চালাতে ব্যবহৃত হয়। এটা অনেকটা এমন যে, নিজের পক্ষে বা নিজের লেখা আর্টিকেল সমর্থন করতে অন্য নামে ভুয়া আইডি খুলে কমেন্ট বা রিভিউ দেয়া।
এরপর আসে বার্নার একাউন্ট যেগুলোকে ভাবানুবাদ করে বলা হয় গুহামানব। এটি সাময়িক বা এককালীন উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় এবং কাজ শেষ হলে পরিত্যক্ত হয়। সাধারণত স্পর্শকাতর বা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে ব্যবহার হয়।
হুইসেলব্লোয়ার বা সাংবাদিকরা মাঝে মাঝে এই ধরনের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে। তবে আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন দেশের যেকোন সেন্সিটিভ ইস্যুর সময় এমন কিছু একাউন্ট আপনারা দেখেন যা আগেও দেখেননি আবার ইস্যু শেষ হলে নাই হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল, ট্রল একাউন্ট। গোপন পরিচয়ে অন্যদের উস্কানি দেওয়া বা উত্তেজিত করার জন্য এই ধরনের একাউন্ট তৈরি করা হয়। রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সামাজিক ইস্যুতে বিতর্ক তৈরি করা মূল উদ্দেশ্য।
ট্রলরা সাধারণত ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, মানুষকে বিভ্রান্ত করে বা কাউকে অপমান করে। ট্রলার একাউন্টগুলো কখনও ব্ল্যাক হয় আবার কখনও হোয়াইট। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রে ট্রলাররাও বেশ ভূমিকা রাখে অনলাইন রাজনীতিতে।
সম্পূর্ণ মিথ্যা পরিচয়ে অন্য কারও ছবি বা তথ্য ব্যবহার করে যে একাউন্ট খোলা হয় তাকে বলা হয় ক্যাটফিশ একাউন্ট। সাধারণত প্রেম-প্রতারণা, আর্থিক প্রতারণা বা বিভ্রান্তিকর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন মানুষের অনুভূতি বা বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা হয়।
বিশেষ সংস্থা, নিরাপত্তা বাহিনী বা গোপন অনুসন্ধান চালানোর জন্য তৈরি করা একাউন্টকে বলা হয় স্টিলথ একাউন্ট বা গোয়েন্দা একাউন্ট। এই ধরনের একাউন্টের মাধ্যমে বিশেষ ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিপক্ষের ওপর নজরদারি করা হয়। অনেক সময় গোপন তদন্ত বা আন্ডারকভার মিশনের জন্যও ব্যবহৃত হয়।
রাজনৈতিক প্রচারণা, জনমত গঠন এবং প্রভাব বিস্তারের জন্য সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে হিউম্যান ফেক অ্যাকাউন্টের ব্যবহারও বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে। এসব অ্যাকাউন্টগুলো সরাসরি কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা বট নয়, বরং মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু বটের মতো স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রম চালায়।
ভবিষ্যতে, রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ধরনের অ্যাকাউন্টগুলো আরও সুসংগঠিত, কৌশলগত ও জটিল হয়ে উঠবে, যা গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এটি রাজনৈতিক প্রচারণার এক নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে, যার ফলে বাস্তব ও কৃত্রিম জনমতের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যাবে।
মানুষের পরিচালিত ফেক অ্যাকাউন্টে AI ও অটোমেশন টুল যুক্ত হবে, যা কার্যত বটের মতো কাজ করবে। উন্নত AI-চালিত চ্যাটবটের মাধ্যমে ফেক অ্যাকাউন্টগুলো আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। এগুলো মানুষের ইমোশন বুঝে কনটেন্ট তৈরি করতে পারবে, যা প্রভাবিত করতে আরও কার্যকর হবে।
রাজনৈতিক দল ও সরকার পরিচালিত ট্রল ফার্ম আরও সুসংগঠিত হবে, যেখানে হাজার হাজার কর্মী ফেক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবে। বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে সরকার বা বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত ট্রল ফার্মের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
কোথাও কোঠাও রাজনীতিবীদরা নিজস্ব বট ফার্মের পাশাপাশি ট্রল ফার্মও গড়ে তুলছে। ভবিষ্যতে এগুলো আরও শক্তিশালী হবে, যেখানে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ পোস্ট, কমেন্ট, মিম এবং ভিডিও তৈরি করা হবে।
সবচ্যে এভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হবে পেইড ব্লু টিকের জন্য। বর্তমানের তুলনায় ফেসবুক, টুইটার (X), ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের ব্লু-টিক একাউন্টেরও অপব্যবহার ভবিষ্যতে ভয়ংকর রূপ নিবে।
ভুয়া সাংবাদিক, গবেষক, নেতা বা বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে ফেক একাউন্ট পরিচালনা করা হবে, যা সাধারণ মানুষ সহজেই বিশ্বাস করবে। সাধারণ মানুষ সবসময় ক্রসচেক করার অবস্থায় থাকে না। তাই তারা ব্লু টিক দেখেই ভরসা করবে ফলাফল বড় ধরনের ম্যাসাকার হয়ে যাবার সমাভবনা রয়েছে।
আপনারা জানেন বিজেপির আইটি সেল কিভাবে কাজ করে রাজনীটিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য। অথবা ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাসিয়ার ট্রল ফার্ম কিভাবে কাজ করেছে। এই একই বিষয় এখন গোটা দুনিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতেছে। রাজনৈতিক দল বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হাজার হাজার ফেক আইডি ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে কৃত্রিম সমর্থন বা বিরোধিতা তৈরি করতে পারে।
অ্যাস্ট্রোটার্ফিং কৌশল ব্যবহার করে জনমতকে সত্যিকারের মতামত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা বাস্তবে মূল জনগণের মনোভাবের প্রতিফলন নয়। সাধারণ মানুষ আসল জনমত ও ফেক জনমতের পার্থক্য বুঝতে পারে না, ফলে ভুয়া জনপ্রিয়তা বা অসন্তোষের শিকার হয়।
রাজনৈতিক বিরোধীদের দুর্বল করতে ও সত্যিকারের আন্দোলন দমনে ফেক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়। যা আমরা জুলাই আন্দোলনের সময় দেখেছি।
সে সময় প্রচুর বার্নার একাউন্ট বা গুহামানব হাজির হয়েছিল অনলাইনে যারা আওয়ামী লীগের পক্ষে গুজব, অপপ্রচার ও ডিজিটাল হুমকি দিয়ে আন্দোলনকে থামাতে চেয়েছিল। এছাড়াও এই একাউন্টগুলো অনলাইনে ফেক ক্যাম্পেইন চালাতো আন্দোলনকে দমাতে।
এই ধরনের অনলাইন কার্যক্রম গণতন্ত্রের জন্য খুবই ভয়ংকর। এসব কার্যক্রমের জন্য জনগণের সত্যিকারের মতামত সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার মধ্যে হারিয়ে যাবে। স্বাধীন সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়বে। সত্যিকারের তথ্য প্রচার করা কঠিন হয়ে উঠবে।
বাস্তবের রাজনীতিতে কারা জনপ্রিয় আর কারা শুধু ফেক প্রচারণার মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তা বোঝা কঠিন হবে। ভোটাররা আসল ও নকল তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানিপুলেশনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে।
এই রাজনৈতিক লড়াইটা আসলে খুব একতা সহজ হবে না। কারণ রাজনীতিবীদরাই চান না এই লড়াইটা করতে। তারাই সহজ পথে জনপ্রিয় হতে এসব ফার্ম চালাচ্ছেন। তবুও আমাদের ফেক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত ও নিষিদ্ধ করার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করা দরকার।
গণমাধ্যমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। যাতে গণমাধ্যম তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। সাধারণ জনগণকে ফেক অ্যাকাউন্ট চেনার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজের পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল লিটারেসি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
হিউম্যান ফেক অ্যাকাউন্ট রাজনীতির জন্য এক ভয়ংকর অস্ত্র হয়ে উঠছে। এটি জনমত নিয়ন্ত্রণ, গণতন্ত্র ধ্বংস এবং নির্বাচনী কারচুপি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য প্রায় বিলীন হয়ে যাবে। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে ফেক অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
তথ্যসূত্র : Munware Alam Nirjhor