একটা মানুষের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয়, হাট বাজারে আসেন, পাশাপাশি বসে নিয়মিত চা সিগারেটও পান করেন। পোশাক পরিচ্ছদে আস্তো একজন ভদ্রলোক, কথাবার্তাতেও সভ্যতার ছোঁয়া মেলে। কিন্তু হঠাৎ, হঠাৎই তিনি ক্ষেপে ওঠেন, যে কাউকে যা তা বলে ফেলতেও দ্বিধা করেন না। সেদিন তারই ঘনিষ্ট বন্ধুর বাবাকে উপস্থিত জনা বিশেক মানুষের সামনে বেয়াদব, হারামজাদা, অসভ্য, জানোয়ার বলতেও দ্বিধা করলেন না। খবর পেয়ে তারই বন্ধু অর্থাৎ 'বেয়াদব বাবা'র ছেলেটি এসে কথিত ভদ্র লোককে চড় থাপ্পড়, কিল, লাথি মেরে বেহাল করে ফেললেন। ড্রেনের কাদা পানিতে মাখামাখি অবস্থায়ও তাকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ বস করিয়ে তবেই ছাড়া হলো তাকে।
ক'দিন আগে চা দোকানের ফুট ফরমায়েশ খাটা ৮/১০ বছরের এতিম ছেলেটির উপর হঠাৎ চড়াও হতে দেখলাম তাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটির গালে শপাত শপাত চড় বসিয়ে দিলেন এবং লাথি মেরে ছেলেটাকে দোকানের বাইরে ফেলে দিলেন। আশপাশে থাকা মানুষজন তাকে ছেড়ে দিবে কেন? তারাও গণপিটুনি দিয়ে তাকে গলির মোড়ে আসা নিষিদ্ধ করে দিলো। ফলে কয়েক দিন দেখি না তাকে। দু'দিন আগে অফিসে যাওয়ার পথে মহল্লা থেকে দুই কিলোমিটার দূরের রিক্সা স্ট্যান্ডে হঠাৎ দেখি তাকে, ভদ্রলোক দৌড়ে এসে হাত ধরলেন- আর্জি করলেন একসঙ্গে চা পানের। তার সঙ্গে আরেকজন ছিলেন, ভদ্রলোক তাকে শ্যালক বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তার আচরণে অবাক হয়ে যাই, ভাবি এমন বিনয়ী মানুষটা হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে যান কেন, কেনই বা মারমুখী হয়ে ওঠেন?
কৌতূহল আর লুকিয়ে রাখতে পারি না, বলেই ফেলি- সেদিন চা দোকানে হঠাৎ এমন রেগে উঠলেন কেন, ছেলেটা কি করেছিল? জবাবে যা বললেন তা শুনে আমার তো ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। বললেন, আমি চায়ের অর্ডার দেয়ার পরেও অন্য দুই গ্রাহককে চা দিয়ে আমাকে ১০/১২ মিনিট ধরে বসিয়ে রেখেছিল। আমি বলি, বলেন কি? এ অপরাধে এমন ভাবে তাকে মারবেন? তিনি বলেন, না ভাই, ১০/১২ মিনিট নয়, মিনিমাম ২০ মিনিট আমাকে ওয়েটিংয়ে রেখেছিল।
আমি বললাম, ২০ মিনিট কেন- আধা ঘন্টা বসিয়ে রাখলেও কি একটা বাচ্চা ছেলের উপর এভাবে হামলে পড়া যায়?
তখন ভদ্রবেশী লোকটি বললেন,ভাই আমার সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ছোট বেলায় আমার উপর বদ জ্বীনের আছর ছিল। অনেক হুজুর, ওঝা, কবিরাজ দেখিয়ে বদ জ্বীন দূর করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো হঠাৎ হঠাৎ ওই বদ'টা (জ্বীন) আমার মেজাজের উপর আছর করে, তখনই আমি খিঁচড়ে উঠি।
তার আত্মপক্ষ সমর্থন সূচক বলা জ্বীনের গল্পটি আমার মোটেও বিশ্বাস হয়নি। জ্বীনের খেয়ে দেয়ে আর কাজ নাই, শুধু ব্যাটা কে মাইর খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেই ভেগে যায়?
সঙ্গে থাকা তার শ্যালক বলছিলেন, আপার সঙ্গে ঝামেলা হলে, মারামারির মতো কিছু ঘটলে দুলাভাইর মেজাজ তিরিক্ষি থাকে দুই তিন দিন। তখন রাস্তাঘাটে যার তার সঙ্গে গ্যাঞ্জাম করে। তাছাড়া দুলাভাইর গণপিটুনির দারুণ ভাগ্য। সুস্থ হতেও সময় লাগে না। শ্যালকের কথায় দুলাভাইও হেসে ওঠে, হাসতে হয় আমাকেও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি শুধু বলি, জ্বীনের ব্যাপার স্যাপার তো- তাই ঘন ঘন গণধোলাই খেয়েও তার কিছুই হয় না। আবারো পিটুনি খেতে প্রস্তুত হয়ে ওঠেন।
আমি তাদের থেকে বিদায় নিলেও আমার ভাবনা শেষ হতে চায় না। এতো মিশুক একটা মানুষ, অভদ্রতার কোনো চিহ্ন নেই- অথচ তিনি হঠাৎ করেই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন, বাক্যবাণ আর রুক্ষতায় কেমন অমানুষে পরিণত হন। কেমন করে সম্ভব? ভাবতে থাকি তাত্ত্বিক নানা সূত্রের কথা ....
অতিরিক্ত দাম্ভিক শ্রেণীর মানুষ যে কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলে, যে কাউকে কঠিন বাক্যবাণে আহত করার অপচেষ্টা চালায়।
এই একই ধরনের কাজটি করে থাকে অল্প শিক্ষিত, মূর্খ শ্রেণীর মানুষও। তারা মূলত এমন ব্যবহার অহরহ পেয়ে থাকে, সুতরাং অন্য যে কারোর সঙ্গে তেমন ব্যবহার করতে এক দণ্ডও ভাবে না।
আরেকটা শ্রেণীর মানুষও কিন্তু হঠাৎ বিনয়ী এবং হঠাৎই প্রচণ্ড দূর্ব্যবহারকারী হয়ে ওঠে। তারা হচ্ছে নেশাখোর। তাদের দুর্ব্যবহার শুধুই কর্কশ বাক্যবাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তারা রীতিমত মারমুখী হয়ে ওঠে।
কিন্তু যতটুকু জানি, ভদ্রলোক নেশা করেন না, আবার দাম্ভিক হতে হলে মিনিমাম যে সহায় সম্পদ থাকা দরকার তার ছিটে ফোঁটাও নেই। তাহলে দুর্ব্যবহারকারী হয়ে উঠেছেন কেন? কথা-বার্তা, আচরণে মারমুখী কেন? কেনই বা এতো রূঢ়তা?
এটা নিয়েই গোটা রাত ভাবলাম, কিন্তু কোনো সূত্রই মেলাতে পারছিলাম না। অবশেষে তারই ঘনিষ্ট সহকর্মীরা মূল সূত্রটি মিলিয়ে দিলেন, ফাঁস করলেন আসল কাহিনী। জানালেন, বেশভূষা, কথাবার্তায় অনেকেই তাকে শিক্ষিত, মার্জিত ভদ্রলোক ভাবেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য! ভদ্রলোক জুনিয়র হাইস্কুলের গণ্ডি ডিঙাতে পারেননি। আমি এটা শুনে রীতিমত থ' বনে গেলাম। এবার মিলে গেলো তাত্ত্বিক সূত্র।
সত্যিই এসএসসি উত্তীর্ণ হলেই ছেলে মেয়েদের মধ্যে একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, কলেজ লাইফে আমূল বদলে যাওয়ার ধাপে পা পড়ে। ভার্সিটি শিক্ষা আলাদা কিছু দেয় তো বটেই। তবে পারিবারিক শিক্ষা না থাকলে সবকিছুই কর্দমাক্ত হয়ে যায়। বুঝলাম ভদ্রলোকের ভাগ্যে শিক্ষাও জোটেনি, আবার পারিবারিক শিক্ষাও কর্দমাক্ত। আহা কপাল! ইসলামেও তিনি মর্যাদাহীন, মুমিন হওয়া তার ভাগ্য নেই।
সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৭). মুমিন কাউকে বাক্যবাণে জর্জরিত করে না. মুমিন কথাবার্তায় সংযত হয়। সে কাউকে কথার মাধ্যমে আহত করে না।
- তার মানে বাক্যবাণে অপরকে আঘাত করা ব্যক্তি মুমিন নয়?
Chief Editor: Saidur Rahman Rimon
Acting Editor: Neamul Hassan Neaz
Office: +8809611584881, 01320950171
E-mail: newsnbb365@gmail.com
Copyright © 2025 NBB. All rights reserved.