নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশের পুলিশ৷ গণঅভ্যুত্থানে বড় ধরনের ধাক্কার পর সক্রিয় হচ্ছে তারা ধীরে ধীরে৷ গঠন করা হয়েছে সংস্কার কমিশন৷ পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার৷ তাতেই কি বদলে যাবে পুলিশ?
এই যে পথে আনতে না পারা—এটা একটা বাস্তবতা৷ এর বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হচ্ছে—সরকার কি আদৌ তাদেরকে লাইনে আনতে চেয়েছে? সে জন্য তারা কি এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?
একটা গণঅভ্যুত্থানের পর এই সরকার দায়িত্বে এসেছে৷ আগের সরকার পালিয়েছে৷ হাসিনা সরকার কিন্তু দু-একদিন নয়, প্রবল দাপটে ক্ষমতায় ছিল টানা পনেরো বছর৷ এই পুরো সময়টা জুড়ে তাদেরকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছে যারা, তাদের মধ্যে প্রথমেই উচ্চারিত হবে পুলিশ বিভাগের নাম৷ আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হেন কাজ নেই, যা তারা করেনি৷ বিনিময়ে সরকারও তাদেরকে দিয়েছে যথেচ্ছ দুর্নীতি করার অবাধ স্বাধীনতা৷ ফলে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল, পুলিশ শব্দটাই যেন সাধারণ মানুষের কাছে ভীতিকর হিসাবে বিবেচিত হচ্ছিল৷
গত বছরের জুলাই মাসে যখন আন্দোলনটা শুরু হয়, ছাত্র-জনতার মুখোমুখি অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়েছিল এই পুলিশ বাহিনীই৷ নির্দয়ের মতো গুলি চালিয়েছে নিরস্ত্র মানুষকে লক্ষ্য করে৷ তারাই যেন ছিল সরকারের পক্ষাবলম্বনকারী প্রধান শক্তি৷ ফলে এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের কাছেও প্রধান ও প্রথম প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছিল দেশের পুলিশ বাহিনী৷ এমন পরিস্থিতিতে স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর স্বভাবতই পুলিশ বাহিনী স্বস্তিতে ছিল না৷ তাদের প্রভাবশালী ও শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাই পালিয়েছে, অনেকে গ্রেফতার হয়েছে৷ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে৷ অনেকের মধ্যে এতটাই ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছুদিন তারা অফিসে পর্যন্ত যায়নি৷ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদেরকে ডেকে আনতে হয়েছে৷
আন্দোলন চলাকালে পুলিশের ওপর আক্রমণের সকল ঘটনাই যে খুব যৌক্তিক ছিল সেটা কিন্তু বলা যাবে না৷ জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের অনেক জায়গায় হয়ত আন্দোলন নিয়ে মাঠ অতটা উত্তপ্ত ছিলই না, তারপরও সেখানে আক্রান্ত হয়েছে থানা, লুটপাট হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র৷ সে অস্ত্রের কিছু উদ্ধার হয়েছে, কিছু হয়নি৷ আবার মুখোমুখি সংঘর্ষে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি পুলিশও মারা গেছে৷ কিন্তু নিহত সেই পুলিশকে যখন ফ্লাইওভারে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেটাকে সমালোচনা না করে বরং বাহবা দেওয়া হয়েছে, তখন স্বভাবতই সেটা পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে৷ এরপর আবার আন্দোলনে নিহত পুলিশদের বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যখন ইনডেমনিটির কথা এসেছে, অবধারিতভাবেই সেটা পুলিশ বাহিনীর মনোবলকে ভেঙে দিয়েছে৷ ভাঙা সেই মনোবল চাঙ্গা করার কোনো উদ্যোগ কি এ যাবত দেখা গেছে? ইউনূস সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনকে শুরুর কয়েক দিন এ ব্যাপারে বেশ উদ্যোগী বলে মনে হয়েছিল৷ কিন্তু দ্রুতই তাকে সরিয়ে দেওয়ায়, পুরো বিষয়টিই যেন থমকে গেছে৷
এরমধ্যে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুদফায় বেশ কয়েকটি খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে৷ প্রথম দফায় যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়, তার মধ্যে পুলিশও একটি৷ তারা পুলিশ বিভাগকে যেন নতুনভাবে সাজাতে চায়৷ এরই মধ্যে চারটি কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে৷ এই চারটির মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনও রয়েছে৷ এই রিপোর্টের যতটুকু এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা দেশে আগামী দিনের পুলিশ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ বোধকরি থাকবে না৷ সত্যি কথা বলতে কি, প্রকাশিত এই রিপোর্টে আমি পুলিশ বাহিনীর মৌলিক কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব দেখিনি৷
আসলে পুলিশের মধ্যে কী পরিবর্তন মানুষ আশা করেছিল? সংস্কার কমিশন গঠনের পর তারা সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে একটা জরিপ করেছিল৷ প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সে জরিপে তাদের মতামত দিয়েছে৷ এই মতামতদানকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৯ দশমিক ৫ বলেছেন তারা এমন পুলিশ বাহিনী চায়, যারা হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ, আইনের প্রতি অনুগত এবং দুর্নীতিমুক্ত৷ ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে অপরাধী পুলিশের জবাবদিহিত ও শাস্তি যেন নিশ্চিত হয়৷ ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন—পুলিশ যেন ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে৷ জরিপে আরও অনেক প্রশ্ন ছিল, আমি এই তিনটি প্রধান বিষয়ই কেবল উল্লেখ করলাম৷ এ থেকেই আসলে বোঝা যায় মানুষ আসলে কেমন পুলিশ বাহিনী দেখতে চায়৷ মানুষের এই প্রত্যাশাগুলো আসলে তাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার আলোকেই যে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা বোঝা যায়৷ মানুষ এতদিন দেখেছে, রাজনীতি প্রভাবিত পুলিশ এতদিন কীভাবে দেশজুড়ে বিরোধী রাজনৈতিকদের হয়রানি করেছে৷ দেখেছে সাধারণ মানুষ কীভাবে পুলিশের কাছ থেকে অন্যায়ের প্রতিকার প্রাপ্তির পরিবর্তে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে৷ অনেক সময় দেখা গেছে, মিথ্যা মামলায় ঢুকিয়ে বা ঢোকানোর ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হয়েছে৷ এরকম অন্যায় প্রতিকার চাইতে গেলেও সাধারণ মানুষকে পড়তে হয়েছে বাড়তি ভোগান্তির মধ্যে৷ পুলিশের নিয়োগেও ছিল রাজনীতির প্রবল প্রভাব৷ বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতাও বিবেচিত হয়েছে পুলিশে চাকরি পাওয়ার অযোগ্যতা হিসাবে৷ সাধারণ মানুষ এসবেরই অবসান চেয়েছে৷
পুলিশ সংস্কারের যে সকল প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে কি মানুষের ওই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে? অথবা পূরণের কোনো সম্ভাবনা থাকবে? সংস্কার প্রস্তাবগুলো পড়ে আসলে সুস্পষ্ট কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না৷ আমরা যদি রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলি, সংস্কার প্রস্তাবে সেটা নিরসনের সুস্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা আছে বলে আমার মনে হয়নি৷ সংস্কার প্রস্তাবে অবশ্য ‘প্রভাবমুক্ত’ পুলিশ কমিশন গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে৷ তবে সেই পুলিশ কমিশন কার প্রভাবমুক্ত হবে—সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি৷ খসড়া প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ‘স্বাধীন’ পুলিশ কমিশনে জাতীয় সংসদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুজন করে সদস্য থাকবেন৷ এমন প্রস্তাব কি পুলিশকে রাজনীতির বাইরে নিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? নাকি এর মাধ্যমে আরও বেশি রাজনীতির মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে? সংসদ সদস্য—তা নিয়ে যে দলেরই হোন না কেন, তিনি তো রাজনৈতিক ব্যক্তিই৷ একাধিক দলের সংসদ সদস্যরা যদি পুলিশ কমিশনে থাকেন, তাতে কি পুলিশের মধ্যে রাজনীতি আরও বেড়ে যাবে না? নিয়োগ বদলি পদোন্নতিতে তখন রাজনৈতিক ভাগাভাগির মতো দৃশ্যও দেখতে হতে পারে৷ আর একটি সুপারিশে পুলিশের দুর্নীতি প্রতিকারে একটি ‘সর্বদলীয় কমিটি’র ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু সর্বদলীয় দলে কারা কী প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবেন, সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই৷
বিগত সরকারের আমলে নানা ধরনের গুম খুনের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল৷ রাতে বিরাতে মানুষের বাসায় গিয়ে মানুষকে ধরে আনা হতো নানা ঠুনকো অজুহাতে৷ তারপর থেকেই শুরু হতো নানা ধরনের হুমকি-ধামকি, অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা৷ দাবি অনুযায়ী অর্থ না পেলে ক্রস ফায়ারের নামে চলতো বিচারবহির্ভূত হত্যা৷ কখনো কখনো গুম করে ফেলা হতো৷ এ বিষয়টা দেখলাম সংস্কার সুপারিশে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে৷ বলা হয়েছে আদালতের আদেশ ছাড়া এফআইআর বহির্ভূত আসামিকে গ্রেপ্তার করা যাবে না৷ এই প্রস্তাবটিকে অবশ্যই আমার কাছে ইতিবাচক বলে মনে হয়েছে৷ এরকম আর একটি বিষয়কে বেশ ভালো বলে মনে হয়েছে৷ মাঝে মাঝে দেখা যায়, কোন একটা অভিযোগে কাউকে গ্রেপ্তার করেই পুলিশ বা র্যাব তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করে৷ এটা আসলে অনৈতিক৷ এতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়ে যায়৷ পরবর্তীকালে আদালতে ওই ব্যক্তি নিরপরাধী প্রমাণিত হলেও শুরুর ওই মিডিয়া ট্রায়াল তার সামাজিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়৷ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে এ বিষয়টি উঠে এসেছে৷ একটি সুপারিশে বলা হয়েছে, বিচারিক প্রক্রিয়ায় চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমের সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না৷
যে কেউ বলবেন, সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব দেওয়া হয়ত খুব একটা কঠিন নয়, বরং কঠিনতম বিষয় হচ্ছে সমাজের প্রতিকূল ব্যবস্থার মধ্যে সেই সুন্দর প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা৷ রাজনীতি যদি ঠিক করা না যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন না হয়, তাহলে পুলিশকে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার৷ যতটা নৈতিক দৃঢ়তা থাকলে পুলিশের একজন নিম্নতম সদস্যও মন্ত্রী-এমপিদের অন্যায় অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে, সেটা কি আমাদের এই সামাজিক বাস্তবতায় সম্ভব? তেমন একজন দৃঢ়চেতা পুলিশকে কি তার প্রশাসন যথাযথ প্রটেকশন দিতে পারবে? না পারলে ভালো ভালো সংস্কার প্রস্তাব হয়ত কেবল খাতা-কলমেই থেকে যাবে৷ অথবা পোশাক পরিবর্তনের মতো কিছু এলোমেলো কাজের মধ্যেই সাফল্য খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হবে৷
প্রাসঙ্গিকভাবে পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি যখন এসেই গেল, সেটা নিয়ে কিছু কথা বলি। এই সব সংস্কার প্রস্তাব যখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করা হচ্ছিল, তার পাশাপাশি সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটা উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিলো পুলিশের চরিত্র পরিবর্তনের জন্য। তারা পুলিশ, র্যাব আর আনসারের পোশাক পরিবর্তনের একটা ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। পোশাক বলতে কেবল কাপড়ের রং পরিবর্তনের বিষয়টিই আমরা দেখতে পেলাম। পুলিশের পোশাক সরকার সরবরাহ করে থাকে। ফলে প্রায় দুই লাখ পুলিশ, বিপুলসংখ্যক আনসার ও র্যাবের জন্য এবার নতুন করে পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। এই খাতে ব্যয় কত হবে? তিন উপদেষ্টা বসে যে বিফ্রিংয়ে নতুন পোশাকের কথা জানালেন, সেখানে কিন্তু ব্যয়ের কথা কিছু বলা হলো না। আচ্ছা, পোশাক পাল্টে গেলে কি চরিত্রও পাল্টে যায়? মানুষের স্বভাব বদলানো যদি এতই সহজ হয়, তাহলে সকল দাগি চোর ডাকাতকে পাঞ্জাবি-পাজামা, আলখাল্লা আর টুপি পরিয়ে দিলেই হয়।
সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত পুলিশ পরিচালনায় ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব৷ বেশি আলোচিত-সমালোচিত পোশাক পরিবর্তনের প্রস্তাব৷
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কিছুতেই পুলিশ বদলাবে না৷
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘এর আগেও ইউএনডিপির ফান্ডে এরকম সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি৷ এবার কমিশন যা প্রস্তাব করেছে, তাতে তেমন নতুন কিছু নাই৷ তবে যদি পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগ তদন্তে পুলিশের বাইরে আলাদা তদন্ত সংস্থা হতো, তাহলে পুলিশের জবাবদিহিতা বাড়তো আর সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেতো৷”
পুলিশ সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, তাকে তারা ১৫টি ভাগে ভাগ করেছে৷ তা করতে গিয়ে তারা ২২টি আইনের সংস্কার চায়৷ পুলিশ বাহিনী পরিচালনার জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুলিশ পরিচালিত হবে এই কমিশনের মাধ্যমে৷ কমিশনে জাতীয় সংসদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুজন করে সদস্য থাকবে৷ জুলাই-আগস্টে হতাহতদের জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন৷ পাশাপাশি পুলিশ যেন রাজনৈতিক দলের বাহিনীতে পরিণত না হয় এবং বেআইনি বল প্রয়োগ না করতে পারে, এমন বিধান রেখে বিদ্যমান আইন সংস্কারের সুপারিশও করা হয়েছে৷
আরো কিছু সংস্কার প্রস্তাব
উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে যেসব প্রযুক্তিগত কৌশল উন্নত বিশ্বে ব্যবহার করা হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে পাঁচ ধাপে বল প্রয়োগের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে৷ এই ধাপগুলো জাতিসংঘ কর্তৃক বল প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে৷ এতে ন্যূনতম ক্ষয়-ক্ষতি এবং প্রাণহানির ঝুঁকি এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে৷
সুপারিশে গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে৷
আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া ‘জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ’ তৈরি, নারী আসামিকে শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথাও রয়েছে প্রস্তাবে৷
এছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে মামলা দেয়ার অপচর্চা বন্ধ করা, বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন না করার সুপারিশও করা হয়েছে৷
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরাসরি সব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করার কথা হয়েছে৷
আরো আছে পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ও জনবান্ধব পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে র্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয় পুনর্মূল্যায়ন করার কথা৷
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য একটি বিশেষায়িত দল গঠন করা, যাদের তদন্ত সংক্রান্ত ইউনিট ও থানা ব্যতীত অন্যত্র বদলি করা যাবে না৷
পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের বিষয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রধারী(এনআইডি) চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা রহিত করা, রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই-বাছাই বন্ধ, ভ্যারিফিকেশনের কাজ সর্বোচ্চ এক মাসের মাধ্যে শেষ করা এবং অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজনে ১৫ দিন বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে৷
পুলিশের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিটি থানা বা উপজেলায় একটি ‘সর্বদলীয় কমিটি’ গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে৷
রাতের বেলায় (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়) গৃহ তল্লাশি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে- এমন কথাও রয়েছে সেখানে৷
এছাড়া পুলিশে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এসব বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন৷
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকে এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছে পুলিশ। ট্রমা কাটিয়ে পুলিশের পুরোদমে কাজে ফেরার উপায় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম : যেভাবে ওদের ব্যবহার করা হয়েছে, ওদের তো কমান্ডার যেভাবে নির্দেশনা দেন, সেভাবে ওরা করতে বাধ্য হয়৷ সরকার তো ব্যবহার করেছে৷ যেহেতু ওরা একটু বেশি করে ফেলেছে, সরাসরি মেরেছে স্টুডেন্টদের বা প্রোটেস্টারদের, ফলে ওরা এখন ভয় পাচ্ছে৷ এটা তো স্বাভাবিকভাবেই হওয়ার কথা৷ যদি সাধারণভাবে বলি, ট্রমা থেকে বের হওয়া কঠিন৷ এটা নির্ভর করে কখন কোন পরিস্থিতিতে ট্রমাটাইজ হয়েছে তার ওপর৷ ট্রমার অনেকগুলো ধরন আছে৷ যেমন, ছোটবেলায় যদি কেউ সেক্সসুয়ালি অ্যাবিউজড হয় বা মা-বাবার অনৈতিক কিছু দেখে যদি সে ট্রমাটাইজ হয়, এমন অনেক ট্রমা আমরা ছোটবেলায় ফেস করি৷ এই ট্রমাটা সারাজীবন ধরে আমাদের পীড়া দিতে থাকে৷ এ কারণে নানা ধরনের মানসিক অসুস্থ্যতা হয়৷ কিন্তু এদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা তো অ্যাডাল্টদের হয়েছে৷ এখন এরা কোন ধরনের ট্রমায় ভুগছে সেটা আমরা নির্ধারণ করতে পারছি না৷ এটা নির্ধারণ করা খুবই মুশকিল৷ যতক্ষন না তারা সেটা বলছে৷ ওরা তো এগিয়ে আসছে না যে, ‘আমরা ট্রমাটাইজ হয়েছি তোমরা আমাদের সহযোগিতা করো৷’
তাদের স্বাভাবিক কাজে ফিরিয়ে আনতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন বা সরকারের কিছু করণীয় আছে?
মানসিক অসুস্থতা নিয়ে জেনারেলি বলা মুশকিল৷ এখানে ব্যক্তি ধরে ধরে সমস্যার সমাধান করতে হয়৷ এখন ধরেন, আমি এভাবে বলতে পারি, তোমরা ভয় পেয়ো না, তোমাদের কিছু হবে না৷ উপর থেকে এভাবে বলা যায়৷ কিন্তু অভিভাবকরা বাচ্চাদের কখন আমাদের কাছে নিয়ে আসেন? যখন তারা চেষ্টা করে ব্যর্থ হন৷ আমি করোনার সময় অনেকগুলো কেস পেয়েছি৷ তারা প্যানিক অ্যাটাকে ভুগছিল৷ তারা রাতে ঘুমালেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এবং তাদের মনে হচ্ছে, তারা এক্ষুনি মারা যাবে৷ তাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে আমি দেখেছি, রুটটা অনেক পেছনে৷ এখন ধরেন, পুলিশের যারা কাজে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, তাদের আগে কোনো ট্রমা ছিল কিনা৷ মানসিক স্বাস্থ্যটা ভিন্ন একটা ক্ষেত্র৷ একটা মলম দিয়ে দিলে কিছু হবে না৷ এখন ঊর্ধ্বতনরা তাদের নিয়ে বসলেও হবে না, কারণ ঊর্ধ্বতনদের তো ট্রমার স্কিলটা নেই৷ এখন কার মধ্যে কতটুকু ট্রমা কাজ করছে, সেটা দেখতে হবে৷
পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ এতে কি মানসিকতায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাবো?
না৷ আমি এই সিদ্ধান্ত একেবারেই পছন্দ করিনি৷ একদমই চিন্তা করে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়নি৷উপর থেকে কাপড় বদলে দিলে কী হবে? এতে কি মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে? অথবা তাদের ভেতরে যে ভয়টা জমেছে, সেখান থেকে বের হতে পারবে? এটা তো সম্ভব না৷ আমরা সবকিছু উপর থেকে মলম দিয়ে করতে চাই৷ এটাও অনেকটা মলম লাগানোর মতো৷
আমরা দেখছি, অন্য ক্ষেত্রে সরকার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে৷ যেমন স্কুলে বেতের ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে৷ এখন তো শুধু পুলিশের পরিবর্তন হলে হবে না, সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনও দরকার৷ সেটা হবে কিভাবে?
সাধারণ মানুষও তো ভীতির মধ্যে আছে৷ তারাও তো কষ্টের মধ্যে আছেন৷ বেতের বিষয়টা উঠাতেই মনে পড়ে গেল, আমি ওই অনুষ্ঠানটাতে ছিলাম৷ ব্যারিস্টার সারা হোসেন মামলাটি করেছিলেন৷ অনুষ্ঠানে সবাই বললেন, যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত৷ সবাই প্রসংশা করলেন৷ কিন্তু আমি শেষে বক্তব্য দিতে গিয়ে বললাম, এই সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হয়নি৷ শিক্ষকের কাছ থেকে বেত কেড়ে নিলাম, কিন্তু তাকে বিকল্প কোনো অপশন তো দিলাম না, তাকে আমরা কোনো ট্রেনিংও দেইনি৷ একটা ক্লাসে ৮০ জন থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকে, শিক্ষক কিভাবে তাদের সামলাবেন? আমরা শিক্ষকদের বেতন বাড়াইনি, জীবন মান উন্নয়ন করিনি৷ অথচ অনেক সুন্দর সুন্দর পদ্ধতি আছে, কিভাবে ক্লাসরুম সামলাতে হয়৷ শিক্ষক ক্লাসে কিভাবে শৃঙ্খলা রাখবেন? পুলিশের কাপড় পরিবর্তন বা বেত কেড়ে নেওয়াকে আমি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখি না৷
পুলিশের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে পরিবর্তন হতে পারে?
পুলিশের প্রতি আমাদের রাগটা এত তাড়াতাড়ি কমবে না৷ আমাদের মধ্যে যে ভয় ঢুকেছে, রাগ হয়েছে, বিরক্ত হয়েছি- সেটা যেতে সময় লাগবে৷ জনগণ কি পুলিশকে গিয়ে বলবে যে, ‘আপনারা মন খারাপ করেন না, আমরা আপনাদের সহায়তা করবো৷’
অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখছি, পথে-ঘাটে পুলিশকে নিগৃহীত করা হচ্ছে৷ পুলিশ কিছু বললেই উল্টো তাদের উপর চড়াও হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ এমন পরিস্থিতিতে পরিবর্তনটা কিভাবে হবে?
এটাকে বলা হয় মব আচরণ৷ মানুষ যখন একত্রে থাকে, তখন এক ধরনের আচরণ করে৷ আবার যখন একা থাকে, তখন আরেক ধরনের আচরণ করে৷ এই পুলিশই হয়ত, কাউকে একা পেলে অন্য ধরনের আচরণ করবে৷ আবার মব যখন আক্রমণ করে, তখন সে ক্ষমা চাচ্ছে৷ একটা মবের আচরণ পরিবর্তনের জন্য সামাজিকভাবে কাজ করতে হবে৷ এই পরিস্থিতিতে যেটা হতে পারে, পুলিশের উর্ধ্বতন যারা কর্মকর্তা আছেন, তারা প্রচুর কর্মশালার আয়োজন করতে পারেন৷ যারা বেশি ভীতু আছে তাদের নিয়ে৷ আবার যারা অপারেশনে যাচ্ছেন, তাদের নিয়েও আয়োজন করা যেতে পারে৷ সেখানে যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, তাদের ডাকা যেতে পারে৷ তখন তাদের কথা আলাদাভাবে শুনে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা মন খুলে কথা বলতে পারে৷ তখন দেখা যাবে, এদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়াবহভাবে মানসিক অসুস্থতায় পড়েছে৷ তাদের দেখা যাবে, রাতেও ঘুম ভেঙে যাচ্ছে৷ তারা ভয় পাচ্ছেন৷
এত মানুষের দেশে সমাজে যেখানে অস্থিরতা রয়েছে, সেখানে কোনো একটি বাহিনীর কাছে ‘বন্ধুসুলভ’ আচরণ প্রত্যাশা করা কতটা সঠিক?
এত মানুষের দেশ বলে কি আমরা কিছু আশা করবো না? মানুষের সংখ্যা দেখেই তো পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়৷ আমি জানি না, দেশে এখন কত মানুষের জন্য কতজন পুলিশ আছেন৷ এত মানুষের দেশ হলেও আমরা যদি উদ্যোগগুলো নিতে পারতাম, স্কুলগুলোতে যদি সঠিক উদ্যোগ নিতে পারতাম, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না৷ ছোটবেলা থেকে যদি এগুলো শেখানো যেতো, পুলিশরা তো এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে৷ পুরো সোসাইটির মধ্যে কাজ করা দরকার৷ আসলে নৈতিক শিক্ষায় আমরা একেবারেই ফেল করে গেছি, নৈতিক শিক্ষাটাই আমরা শিখিনি৷
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর অভিযোগের তির বাংলাদেশের পুলিশের দিকে। সরকার পরিবর্তনের পর সংস্কারসহ কিছু উদ্যোগের মধ্য দিয়ে পুলিশকে পরিবর্তন এবং সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে।
সবচেয়ে আলোচিত পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ৷ এসব নিয়েই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মো. নুরুল হুদা।
মো. নুরুল হুদা : আমার কাছে এটা অগ্রাধিকারের মধ্যে আসে না। এই মুহুর্তে যে সমস্ত কাজ করা দরকার, তার মধ্যে এটা পড়ে না। পোশোকের পরিবর্তন কাজের মান উন্নত করেছে- এ ধরনের কোনো গবেষণার ফল আমার জানা নেই। বিগত ১০০ বছরে পুলিশের ইউনিফর্ম অন্তত ৩-৪ বার বদল হয়েছে, কিন্তু আচরণগত কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। অতত্রব, এই পোশাক পরিবর্তন কী ধরনের আচরণগত পরিবর্তন আনতে পারবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। সামনের দিনগুলোতে দেখতে হবে।
পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফেরাতে কি কোন উদ্যোগ আপনার নজরে এসেছে?
কিছু তো আছে। একটা বিরাট বড় ঘটনা ঘটে গেছে। সেখানে পুলিশ মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। কিছু কিছু জায়গায় পুলিশ ভার্চুয়ালি গণশত্রুতে পরিণত হয়েছিল। এমন একটি বিরাট ঘটনার পর একটা মনস্তাত্বিক প্রভাব রয়েছে। যেভাবে পুলিশকে দোষারোপ করা হচ্ছে, যদিও পুলিশ একা এই দোষের ভাগীদার না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তাকেই দোষটা বেশি দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু সে অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। কাজ হচ্ছে, কিন্তু এটা অত্যন্ত কঠিন। নতুন লোক পাওয়া মুশকিল, পুরনো লোকদের দিয়েই কাজ করতে হয়। মোটামুটি সন্তোষজনক, কিন্তু আমাদের যে প্রত্যাশা সেটা সম্ভব না।
সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাবনা দিয়েছে তাতে কি জনবান্ধব পুলিশ গড়ে তোলা সম্ভব?
এটা নির্ভর করছে তারা কী ধরনের আইনি রক্ষাকবচের কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, তারা সেরকম কিছু বলেননি। আসলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপরই এটা নির্ভর করে। আইন-শৃঙ্খলা ঠিকমতো রাখতে হলে, যে অনুশাসন প্রয়োজন সেটা যদি না দেওয়া হয় তাহলে তো কোনো পরিবর্তন হবে না। আর যেসব রক্ষাকবচের কথা বলা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তের বিষয়টা রাজনৈতিক নির্বাহীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে বিচার বিভাগের কাছে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। তার জাবদিহি হতে হবে বিচারিক কর্তৃপক্ষের কাছে। সে যেন ফাংশানালি অটোনোমাস হিসেবে কাজ করতে পারে। পুরো স্বাধীনতা ঠিক না, তার কাজের জন্য অটোনোমাস হবে। তার কাজে কেউ বাধা দেবে না। আর কোর্টের তো এখতিয়ার আছেই। তদন্তের সময় যদি সে উল্টোপাল্টা করে, তাহলে কোর্ট তাকে বাদ দিতে পারে। আরো অনেক পরামর্শ আছে, যেগুলো করতে গেলে প্রচুর সম্পদের বিনিয়োগ করতে হবে। আমরা যদি সেই সম্পদের বিনিয়োগ করতে রাজি থাকি, তাহলে হবে। এগুলো প্রস্তাব হিসেবে ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সম্পদের বিনিয়োগ লাগবে।
পুলিশের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?
প্রথমত, পুলিশ রাজনীতিবিদের কথায় চলবে না, আইন মোতাবেক চলবে। আইন মোতাবেক চললে তার বিরুদ্ধে যেন কোনো বন্দোবস্ত না নেওয়া হয়। হয়রানি না করা হয়। এ বিষয়ে দেশে যে বিচারিক কর্তৃপক্ষ আছে, তারা তাকে সুরক্ষা দেবে। উন্নত বা পরিণত গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশকে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। সেখানে এই হস্তক্ষেপ হয় না। যেটা আইনত না, এমন কোনো ব্যবস্থা ওই সব দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে নেওয়া হলে আদালত তাকে সুরক্ষা দেয়। এটা থাকতে হবে। পুলিশ তদন্তের জন্য দায়ী থাকবে বিচার বিভাগের কাছে। এটা আমাদের আইনেও আছে। পুলিশের পদায়ন ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক নির্বাহীদের নাক গলানো বন্ধ করতে হবে। আইজিপিকে ক্ষমতাবান করতে হবে। তাহলে আপনি তার কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাইতে পারবেন। এখনো তাকে জবাবদিহিতা করতে হয়, কিন্তু অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তার নেই।
পুলিশের তো ৫৮টি থানাসহ বিপুল পরিমান গাড়ি ও স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো কিভাবে রিপ্লেস হবে?
যেসব স্বীকৃত পন্থা আছে, সেই পথে যেতে হবে। টেন্ডার করতে হবে। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট কেনার প্রক্রিয়ায় বেশি সময় লাগে না। তাহলে দ্রুত এগুলো পুনর্স্থাপন করা সম্ভব। এখন ওখানে সম্পদের বিনিয়োগ করতে হবে, যদিও এখন আমাদের কৃচ্ছতা সাধন করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। তারপরও আমরা যদি মৌলিক চাহিদা তিনটাকে ধরি- শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, অর্থাৎ এই নিরাপত্তাকে যদি আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দেই, তাহলে এখানে সম্পদের বিনিয়োগ করতে হবে।
এখনো পুলিশকে মাঠে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে না, কেন?
এটার বিভিন্ন কারণ আছে। একটা তো মনোবলের উপর আঘাত। এখনো কয়েকশ’ পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা আছে। অনেকেই চিন্তায় থাকতে পারে, ‘আমি কাজ করতে গেলে আবার আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে কিনা৷’ কোন দিকে কিভাবে কাজ করবো সেটা একটা। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপক হারে বদলি হয়েছে। নতুন জায়গায় এসে কাজ করতে গেলে, বিশেষ করে ঢাকার মতো মেট্রোপলিটন শহরে নতুন লোকজনের পক্ষে সফলভাবে কাজ করা অতি অল্প সময়ের মধ্যে কঠিন। রাস্তা-ঘাট চিনতে হয়, তার ইনফর্মেশন সিস্টেম ঠিক করতে হয়, আরো বেশ কিছু জিনিস আছে। মেট্রোপলিটন পুলিশিং একটু আলাদা হয়। এত বড় একটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর একদল লোককে মনে করা হচ্ছে তারা বিশ্বাসী না, আরেক দলকে মনে হচ্ছে হয়তো তারা বিশ্বাসী। এরকম একটা অবস্থার মধ্যে আমাদের এই সমাজে তো একটা বিভাজন রয়েছে। এই রাজনৈতিক বিভাজনের একটা প্রভাব তো পড়ে মনোবলের উপরে। যদি প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে কাজ করা হয়, তাহলে ঝামেলা হওয়ার কথা না। যখন রাজনৈতিক দলের স্বার্থে কাজ করা হয়, তখন এই ধরনের প্রভাব বেশি পড়ে। তখন যে পরিমান দ্রুত গতিতে কাজ করা দরকার, সেটা সম্ভব হয় না।
পুলিশ তো একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী। অধস্তন পুলিশ সদস্যরা তো ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন করেন, সেক্ষেত্রে তাদের অভিযুক্ত করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
অধস্তনরা ঊর্ধ্বতনদের বেআইনি নির্দেশ শুনতে বাধ্য নয়। এটা বুঝতে হবে, একজন এসআইকে যদি আইজিও অযৌক্তিক আদেশ দেন, তিনি সেটা শুনতে বাধ্য নন। যদিও এটা কেতাবের কথা। কিন্তু বাস্তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা যদি সব ক্ষেত্রে শুনতেই হয়, তাহলে তো আর আইনের প্রয়োজন নেই। আইনে বলা আছে, তুমি আইন অনুযায়ী অর্ডারগুলো মানবে। তবে ডিসিপ্লিন দেখার জন্য এখানে ঊর্ধ্বতনাদের কথা শুনতে হয়। এগুলো হচ্ছে সভ্য সমাজের একটা সিস্টেম। ঊর্ধ্বতন তাকে বেআইনি অর্ডার দেবে না। অধস্তনরাও জানে কোনটা আইনসিদ্ধ আর কোনটা আইন অনুযায়ী না। অতএব ১০০টা ঘটনার মধ্যে বা এক হাজারটা ঘটনার মধ্যে দুই-তিনটা ঘটনায় মতভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় ঊর্ধ্বতনদের আইনানুগ সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার কথা। এটাই স্বাভাবিক সময় হয়। এখন কথা হলো, কেউ যদি আইন মোতাবেক কাজ না করে বা তার বিবেক-বুদ্ধি কাজে না লাগিয়ে শুধু ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনা পালন করেন, তাহলে তো তিনি অভিযুক্ত হতেই পারেন।
নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি, বিচার বা ক্ষতিপূরণ তারা পাবেন কিনা তা নিয়ে হতাশায় দিন কাটছে তাদের। পুলিশ হত্যার বিচার কি আদৌ সম্ভব হবে? যদিও এ ব্যাপারে সরকার এক ধরনের দায়মুক্তি দিয়েছে।
আমি যতদূর শুনেছি, তাদের অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। যদিও এটা অফিসিয়াল না। সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে কিনা জানি না। তবে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত বা বিচারের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা নেই। যেটা আজকে হলো না বলে ভবিষ্যতে আর হবে না- এমনটি ভাবা যাবে না। কোনো বিষয়ে দায়মুক্তির কথা বলা হচ্ছে, যেখানে পুলিশ অফিসাররা বেআইনি কাজ করেছে, বেআইনি কাজ করতে গিয়ে যদি তিনি মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে সেখানে তার প্রটেকশন থাকবে না। কিন্তু তার উপর যদি আক্রমণ হয়ে থাকে এবং তিনি আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সেখানে তদন্ত এবং বিচার হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্বেগ আছে। তাই যেটা বললাম, এখন যদি বিচার না হয় ভবিষ্যতে যে হবে না সেটা বলা যাবে না।
পুলিশ সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় একটা দলীয় প্রভাবের কথা আমরা শুনি। এখন যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেটা কতটা দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে সম্ভব হবে বলে আপনি মনে করেন?
যে দেশে একটা বিষাক্ত বিভাজন হয়েছে সমাজে, বিশেষ করে রাজনৈতিক পর্যায়ে, এখানে দেখা যায় যে একসময় এই জেলার লোক হলে সে চাকরি পাবে না, আরেক সময় আরেক জেলার লোক হলে চাকরি পাবে না৷ এরকম একটা বিপজ্জনকভাবে বিভাজিত সমাজে যখন নিয়োগ হয়, তখন সেটার মধ্যে যে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না সেটার গ্যারান্টি তো দেওয়া মুশকিল। অতএব, সন্দেহ থাকবে এখানে একটা বায়াসনেস কাজ করতে পারে।
পুলিশ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
এটা তো দরকার হয়ই। তবে নিয়মিত সবাই যদি তাদের কাজটা ঠিকমতো করে, তাদের তত্ত্বাবধানের পর্যায়ের লোকগুলো যদি কাজগুলো ঠিকমতো করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যদি ঠিক থাকে, তাহলে তো ঘন ঘন পুলিশ কমিশনের প্রয়োজন পড়ে না। তবে একটা পুলিশ কমিশন হলে তারা অনেক জিনিস দেখতে পারে। ফলে এটা হতে পারে।