সাঈদুর রহমান রিমন:
৯০ দশকে দৌড় পত্রিকা নামে দেশে এক ধরনের পত্রিকার আবির্ভাব হয়েছিল। সাদাকালো ব্রডশিট আকারে চার কিংবা আট পাতায় প্রকাশিত এসব পত্রিকা বিক্রি হতো দুই টাকা দামে। গুলিস্থান, মতিঝিল, পল্টনের ভিড় ভারাক্কা আর ঢাকার বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও সদরঘাট এলাকায় ভাসমান হকাররা পত্রিকাগুলো বিক্রি করত। হকার ওই পত্রিকার নির্দিষ্ট একটা হেডিং মুখে বলে চিল্লাপাল্লা আর ছোটাছুটি করতে থাকত। একেকজন হকার এভাবে প্রতিদিন ৭/৮ শ' পত্রিকাও বিক্রি করে ফেলত। হকাররা যে-সব মুখরোচক হেডিং বলে পাঠকদের আকৃষ্ট করত তা ছিল এ রকম: খালেদা জিয়া মা হয়েছেন! ধর্ষিতা হাসিনা, অবশেষে বিক্রি হলো বাংলাদেশ ইত্যাদি।
খালেদা জিয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদনে চমকে দেওয়ার মতো ইন্ট্রো দিয়েই লেখা শুরু হত। এগারো বছর আগে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তারপর থেকেই খালেদা জিয়ার একাকী জীবন চলছে। বিয়েও বসেননি তিনি, ঘোষণাও দিয়েছেন বিয়ে না বসার। কিন্তু হঠাৎ এ কী হলো? লোকচক্ষুর আড়ালে মা হয়ে গেলেন খালেদা জিয়া! স্বামী ছাড়াই কোথা থেকে এলো এ সন্তান? এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে নানা বিষয় উপস্থাপন, তুলে ধরা হয় ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে বহির্ভূত সন্তান জন্ম দেয়ার পাপ ও কঠিন শাস্তির বিষয়ও।
প্রতিবেদনের শেষ প্রান্তে গিয়ে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে বিমানের মধ্যেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন, আমান উল্লাহ আমান, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ কয়েকজন সরাসরি খালেদা জিয়াকে মা বলে সম্বোধন করলেন, করলেন কদমবুসি। খালেদা জিয়াও তাদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে নিলেন। সবার অলক্ষ্যে চলতি বিমানেই হঠাৎ মা হয়ে গেলেন তিনি। তিন শতাধিক লাইনের লেখায় মাত্র চার লাইনের মাধ্যমে হেডিংয়ের যথার্থতা তুলে ধরার জঘন্য প্রয়াস বুঝে উঠতে পাঠকদের গলদঘর্ম অবস্থায় পড়তে হত।
এতইভাবে ধর্ষিতা হাসিনা প্রতিবেদনও শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিশাল আত্মত্যাগ, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ডের কাহিনি লেখার মধ্য দিয়ে। শেষদিকের কয়েক লাইনে বলা হয়, হাসিনা ধর্ষণের শিরোনামে হয়ত পাঠকরা চমকে উঠবেন, সীমাহীন কষ্টে তাদের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাবে। কিন্তু না, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর দুর্গম পল্লিতে হাসিনা নামের যে তরুণী ধর্ষিতা হয়েছেন তিনি শেখ পরিবারের কেউ নয়। অভাবী রিকশা চালকের কন্যা হাসিনা দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাতের অন্ধকারে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ফাঁকা মাঠে নির্মমভাবে ধর্ষিতা হয়েছেন তিনি। অথচ কাঠের হরফে বিশালকায় অক্ষর বানিয়ে আট কলাম জুড়ে হাসিনা ধর্ষণের হেডিং দেওয়া হয়েছে, যুক্ত করা হয়েছে হাসিনার ছবিখানাও।
১৯৯৬/৯৭ সালের পর থেকে কেন যেন পত্রিকাগুলো আর বাজারে দেখা যায় না। বাংলা বার্তা, সাফকথা, নগরবার্তা, জনকথা কোথায় যে হারিয়ে গেল...। হকাররা দৌড়ে দৌড়ে পত্রিকাগুলো বিক্রি করত বলে পত্রিকার নামই হয়ে উঠেছিল দৌড়ানি পত্রিকা বা দৌড় পত্রিকা। কিন্তু কেন হকাররা দৌড়ে দৌড়ে পত্রিকা বিক্রি করত সে ব্যাপারে গাবতলী টার্মিনালে হকার শাহজাহানের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি। তিনি বলেছিলেন, আমাদের চিল্লাপল্লায় লোকজন যেখানে জড়ো হয়ে যেত সেখানে টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনত বড়জোর ৫/৭ জন, বাকিরা নেড়েচেড়ে দেখত শুধু। তাই এক স্থানে ৫/৭ টা পত্রিকা বিক্রি করে দৌড়ে একটু দূরে গেলেই আবার ৫/৭ টা বিক্রি করা সম্ভব হতো।
দৌড় পত্রিকাগুলোর হেডিংয়ের যথার্থতা মেলানোর জন্য ৪/৫ লাইনের লেখাটুকু খুঁজে পাঠ করে ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠত বৈকি! ভাবতাম, কীসের সঙ্গে কি মিলিয়ে পাঠকদের বিভ্রান্ত করার ধান্ধাবাজি চালানো হয়! সম্পাদকদের কি রুচি!
বহুদিন বহু বছর পরে আজ আবার সেই দৌড় পত্রিকার স্বাদ পেলাম আমার দেশ পত্রিকায়। পাঁচ কলামের লিড নিউজটির মাধ্যমেই মূলত পাঠকদের মাঝে হৈচৈ সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে বটে। কিন্তু পুরো গল্পটি পাঠ করে কোথাও হেডিংয়ের যথার্থতা মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও দেখতে পেলাম না। এমনকি হেডিংয়ে ব্যবহৃত ‘ঢাকা অ্যাটাক’ শব্দটিও বিশাল আয়তনের গল্পটির মধ্যে একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। লেখার ১৪১ তম লাইনে হালকা করে বলা হল- ‘সেখানে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। জানা গেছে, সেখানেও শেখ হাসিনা অজিত দোভালকে ঢাকায় আক্রমণ করতে বলেন।’
লিড নিউজ নামের চর্বিত চর্বনযুক্ত গল্পটি লিখেছেন সৈয়দ আবদাল আহমদ। তিনি আমার খুব, খুবই শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক। নব্বই দশকে দৈনিক বাংলা’য় তার লেখা প্রতিবেদনগুলো রীতিমতো ঝড় তুলতো এবং সেসব প্রতিবেদন কাটিং করে খাতায় পেস্ট করে রাখতাম। তার তথ্য উপস্থাপন, ভাষার গাঁথুনি, অনুসন্ধান প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বারবার সেসব প্রতিবেদন খুটিয়ে খুটিয়ে পাঠ করতাম। বর্তমান পত্রিকার নীতি, আদর্শ, পাঠকদের সস্তায় আকৃষ্ট করার পদ্ধতির সঙ্গে আবদাল ভাইয়ের সেই তোলপাড় সৃষ্টি করা প্রতিবেদনগুলোর কোনো মিল নেই। মিল থাকারও কথা নয়। তখনকার দৈনিক বাংলা’র সম্পাদকরা ছিলেন দেশখ্যাত সাংবাদিক-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তাদের সুখ্যাতি ছিল। আর আজকের সম্পাদকরা হচ্ছেন জীবনের সিংহভাগ সময় আমলা হিসেবে কাটিয়ে আসা বিখ্যাতজন। হয়ত অনেক জানা, বুঝা, লড়াকু সম্পাদক হিসেবে যুগ যুগ তার কদর থাকবে, তাই বলে পেশাদারিত্বের মাঝে থেকে ধাপে ধাপে অর্জিত অভিজ্ঞতায় দক্ষ হয়ে ওঠা সম্ভব হয় কি কখনো?
তারপরও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরে নির্যাতিত সম্পাদক ও সাংবাদিকরা দমে যাননি, আপস করেননি। একযুগ পরে লড়াই করেই আমার দেশ পত্রিকাটি বাজারে এনেছেন- স্যালুট জানাই তাদের, জানাই শুভ কামনা।
Chief Editor: Saidur Rahman Rimon
Acting Editor: Neamul Hassan Neaz
Office: +8809611584881, 01320950171
E-mail: newsnbb365@gmail.com
Copyright © 2025 NBB. All rights reserved.