খুবই ভয়ংকর হয়ে উঠছে রাতের ঢাকা। রাজধানীর রাস্তায় হাঁটা কিংবা যানবাহনে চলাচল বলেন, সর্বত্রই চরম নিরাপত্তাহীনতায় নগরবাসী। সুস্থ অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে ভালোভাবে ফিরতে পারবেন কি না এ নিয়ে শঙ্কায় নগরবাসীর অনেকে। রাজধানীতে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ ও হতাশা কাটছে না নগরবাসীর।
বিশেষকরে রাতের ঢাকায় চলাফেরা করতে গিয়ে বিভিন্ন রাস্তায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন বাসিন্দারা। ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারী নিয়ে যাচ্ছে টাকা ও ব্যাগ। বাধা দিলে জীবনও চলে যাচ্ছে। গত চার মাসে ছিনতাইকারীদের হাতে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে।
নারীকে টেনে নিয়ে গেলো ছিনতাইকারীদের প্রাইভেটকার
ঢাকায় একটি রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের শিক্ষক ফারহানা আক্তার জাহান। হঠাৎ কাছে আসা সাদা রংয়ের একটি প্রাইভেট কারের জানালা থেকে একজন তার হাতে থাকা ব্যাগটি টান মারে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে যান। গাড়ির সঙ্গে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। এনবিবিকে তিনি বলেন, সমাজে মাদকের প্রভাব বেড়েছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি কম, এ কারণেই ছিনতাই বেড়েছে।
‘রাস্তায় বের হতেই ভয় লাগে’
২৭ এপ্রিল মামাতো বোনকে সঙ্গে নিয়ে রাত সোয়া ২টার দিকে বাড়ি থেকে রিক্সায় বাড্ডার একটি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন ব্যারিস্টার মারুফ হোসেন মোল্লা। বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে মোটরসাইকেলে আসা দুই ছিনতাইকারী তাদের মোবাইল ফোন, টাকা নিয়ে যায়। ব্যারিস্টার মোল্লা এনবিবিকে বলেন, ওই ঘটনার পর এখন রাস্তায় বের হতেই ভয় লাগে! দিনে বা রাতে কখনই চলাফেরায় নিরপদ বোধ করছি না। এক ধরনের মানষিক ট্রমার মধ্যে পড়ে গেছি।
ভাইরাল হলে ব্যবস্থা!
পাশ্চম শেওড়াপাড়ায় ভোররাতে চাপাতি ঠোেকয়ে এক তরুণার কাছ থেকে চেইন ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তৎপর হয় পুলিশ। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি রিকশায় দুই যাত্রী একটি গলির মুখে এসে দাঁড়ান। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন এসে রিকশার সামনে থামে। এক ব্যক্তি কোমর থেকে একটি চাপাতি বের করে রিকশায় থাকা তরুণীকে কোপ দেওয়ার অঙ্গভঙ্গি করে এবং ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।
ছিনতাই আতঙ্কে মোহাম্মদপুরের মানুষ
মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের পাশে আজিজ মহল্লার মাদ্রাসা রোড বাইলেন সড়কে দিনের বেলাতেও চলাফেরা মুশকিল। ছিনতাই আতঙ্কে এই এলাকার বাসিন্দারা। রাতে নীরবতা নামলে ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বাড়ে বলে জানালেন বাসিন্দারা। এর সঙ্গে বিহারি ক্যাম্পের কিছু যুবক জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
আপোষে না দিলে মারধর
প্রেসক্লাব এলাকা থেকে একটি রাইড শেয়ারিং বাইক নিয়ে উত্তরার বাসায় ফিরছিলেন সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম। ধানমণ্ডির শুক্রাবাদ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় একটি গলিতে বাইক চালক সাথে আরেকজনকে নিয়ে তার সাথে থাকা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বাধা দেওয়ায় শারীরিক আঘাতের শিকার হন তিনি। এক পর্যায়ে তার ফোন, মানিব্যাগ ছিনতাইকারীরা নিয়ে নেয়। আমিনুল ইসলাম জানান, গুরুতর আহত হয়ে তিনি বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন।
‘মানুষ রাতে বের হতে ভয় পায়’
গত শুক্রবার রাত ৩টার দিকে মোম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় একজন বয়স্ক নারী এক তরুণকে নিয়ে রিক্সায় যাচ্ছিলেন। নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে তিনি বললেন, “ভাই অনেক ঝুঁকি নিয়ে বের হয়েছি। ভয় লাগছে। দোয়া করবেন যেন সুস্থ্যভাবে বাসায় যেতে পারি।” নূরউদ্দিন নামের রিক্সাচালক বলেন, “এখন মানুষ রাতে বের হতে ভয় পায়। তাই খুব একটা ভাড়া হয় না।” জানা গেছে, গত চার মাসে রাজধানীতে ছিনতাইকারীদের হাতে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে।
বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোর চেষ্টা
নিরাপত্তার কারণে এখন অধিকাংশ এলাকার প্রবেশমুখে গেট বসানো হয়েছে। বিশেষ করে মোহাম্মদপুর এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বেশি থাকায় যেখানে সম্ভব সেখানেই গেইট বসিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন এলাকার মানুষ। প্রতিটি গেইটে একজন করে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
র্যাবের টহল
গত শুক্রবার রাতে মোহাম্মদপুর এলাকায় বিহারি ক্যাম্পের সামনে র্যাবের একটি টহল গাড়িকে দেখা গেল। কয়েকদিন আগে মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৮ থেকে ৩০ বছরের ২৬ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাদের কাছ থেকে একটি চাপাতি, ১৩টি চাকু ও ১২টি ক্ষুর উদ্ধার করা হয়। র্যাব জানিয়েছে, মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকায় কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র রয়েছে। তাদের ধরতে টহল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়িয়েছে তারা।
তিন মাসে গ্রেপ্তার এক হাজার
শুক্রবার রাত আড়াইটার দিকে মোম্মদপুর বাসস্টান্ডের কাছে পুলিশের একটি টহল গাড়ি দেখা যায়। তবে মোহাম্মদপুর এলাকার কোথাও র্যাব, পুলিশ বা যৌথবাহিনীর চেকপোস্ট দেখা যায়নি। পুলিশের গণমাধ্যম শাখা জানিয়েছে, তিন মাসে ছিনতাইকারী সন্দেহে তারা প্রায় এক হাজার জনকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ডিবি ও থানা পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। টহল কার্যক্রমের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
টহল জোরদার করার দাবি পুলিশের
ঢাকা মহানগর এলাকায় চুরি, ছিনতাই প্রতিরোধে ডিএমপির টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে বলে এনবিবিকে জানিয়েছেন ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি বলেন, কৌশলগত ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়মিত চেকপোেস্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা করা হচ্ছে।