ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার ব্যবহার সহজ করে তোলার ক্ষেত্রে 'অভ্র' নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জনপ্রিয় সফটওয়্যার। তবে বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার শুরু হয়েছিল আরও আগে, 'শহীদলিপি'র হাত ধরে। আজ যখন সবাই 'অভ্র' বা 'বিজয়'-এর নাম জানে, তখন শহীদলিপি নামটি অনেকের কাছেই অজানা।
'শহীদলিপি' ছিল কম্পিউটারের জন্য প্রথম বাংলা কিবোর্ড লেআউট। ১৯৮৫ সালে লন্ডনে বসবাসকালে প্রকৌশলী সাইফুদ্দিন শহীদ, যিনি সাইফ শহীদ নামেও পরিচিত, এটি তৈরি করেন। অ্যাপল ম্যাকিন্টশের গ্রাফিক্স-ভিত্তিক কম্পিউটারের জন্য এটি ডিজাইন করা হয়েছিল।
সাইফ শহীদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি বেক্সিমকো কম্পিউটারস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ঢাকায় ন্যাশনাল কম্পিউটারস নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেখান থেকে শহীদলিপি বাজারজাত করা হয়।
উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি দেশের প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী সংগঠন 'বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি'র (বিসিএস) প্রথম সহ-সভাপতি ছিলেন। তার হাত ধরেই বাংলা ভাষা প্রথমবারের মতো কম্পিউটারে ব্যবহারের সুযোগ পায়, যা পরবর্তী বাংলা কম্পিউটিংয়ের ভিত তৈরি করে।
শহীদলিপি ছিল একটি ফনেটিক লেআউট, যা কোয়েরটি (QWERTY) কিবোর্ডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি । এর মূল বিন্যাসে প্রায় ১৮২টি বাংলা বর্ণ ও যুক্তাক্ষর ছিল। পরবর্তীতে, এর একটি উইন্ডোজ সংস্করণও বাজারে আসে।
১৯৮৮ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বাংলা কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের জন্য শহীদলিপি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে শহীদলিপি নামটি রেখেছিলেন সাইফ শহীদ । যদিও এর সঙ্গে তার নিজের নামেরও মিল রয়েছে, তবে সেটি নিছকই কাকতালীয় হতে পারে।
ক্যাডেট কলেজে পড়ুয়াদের ব্লগ ওয়েবসাইটে স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি লিখেন, '১৯৫২ সালে আমার বয়েস ৪/৫ বছর। ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারির কোন স্পষ্ট স্মৃতি নেই। তবে একটু বড় হবার পর থেকে দেখতাম, ঐ দিন খুব ভোরে ছাত্ররা খালি পায়ে হেঁটে হাতে ফুল নিয়ে স্থানীয় শহীদ মিনারে মিছিল করে যাচ্ছে। একটু বড় হলে আমিও তাদের সাথে যাওয়া শুরু করলাম। শীতের ঐ ভোরে উঠে সবার সাথে দল বেধে খালি পায়ে হাঁটার মধ্যে কেমন যেন একটা আলাদা উত্তেজনা অনুভব করতাম। চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় মিছিল করার সুযোগ ছিল না, কিন্তু আমার মনে আছি আমি একাকী পিছনের পাহাড়ে উঠে ভাষা শহিদদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতাম।'

'১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ – এ চার বছর যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র – তখন প্রতিটি শহীদ দিবসে শহীদ মিনারে যেতাম প্রভাত ফেরিতে যোগ দিয়ে। শেষের বছরগুলিতে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হবার কারণে আরও ব্যাস্ততায় কাটতো ওই দিনটি। ফলে ১৯৮৫ সালে যখন লন্ডন থেকে কম্পিউটারে প্রথম বাংলায় চিঠি লিখে পাঠালাম ঢাকাতে আমার মাকে, তখন একটা নামই শুধু মনে এসেছিল – তাই এ প্রচেষ্টার নামকরণ করলাম "শহীদলিপি"', যোগ করেন তিনি।
বিজয় কিবোর্ড আসার আগেই শহীদলিপি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটি প্রকাশের পরই বেশ সাড়া ফেলেছিল। সাইফ শহীদ নিজেই বিবিসির এক অনুষ্ঠানে এটি নিয়ে কথা বলেন। সে সময়ের জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পাতায় শহীদলিপিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
প্রথম দিকে শহীদলিপিতে বিটম্যাপ ফন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা প্রকাশনার জন্য খুব একটা উপযোগী ছিল না। পরে সাইফ শহীদ 'লেজার' ফন্ট তৈরি করেন, যা তারকালোক ও দৈনিক আজাদের মতো পত্রিকার প্রকাশনার জন্য ব্যবহার করা হয়।
শুধু শহীদলিপি নয়, তিনি ম্যাকিনটোশ অপারেটিং সিস্টেমের ইউজার ইন্টারফেসও বাংলায় রূপান্তর করেন। ফলে, কম্পিউটারের পর্দায় নির্দেশনাগুলো বাংলায় দেখা সম্ভব হয়।
১৯৮০-এর দশকে যখন গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস ও ওয়ার্ড প্রসেসিং প্রযুক্তি জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তখন ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের জন্য বেশ কয়েকটি বাংলা টাইপিং সিস্টেম তৈরি হয়।

কিন্তু কম্পিউটারে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—একটি উপযোগী কিবোর্ড লে-আউট তৈরি করা, টেক্সট প্রসেসিংয়ের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করা এবং বাংলা অক্ষর প্রদর্শনের জন্য যথাযথ ফন্ট তৈরি করা।
কম্পিউটার কিবোর্ডের ভিত্তি হলো টাইপরাইটারের কিবোর্ড, যেটি কিনা ১৮৭৪ সালে উদ্ভাবিত হয়। তাই সম্পূর্ণ নতুন বাংলা কিবোর্ড ডিজাইন না করে, ইংরেজি কিবোর্ডের ওপর কীভাবে বাংলা অক্ষর বসানো যায়, সেটিই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
১৯৬৫ সালে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী টাইপরাইটারের জন্য একটি বাংলা লে-আউট তৈরি করেন, যাতে টাইপ-বার আটকে যাওয়ার সমস্যা কমে এবং টাইপিং গতি বাড়ে। এটিই ছিল প্রথম বৈজ্ঞানিক বাংলা কিবোর্ড লে-আউট, যা পরে কম্পিউটারেও ব্যবহৃত হয়।
তবে, শুধু কিবোর্ড লে-আউট থাকলেই বাংলা লেখা সম্ভব হতো না। এর জন্য প্রয়োজন ছিল এমন সফটওয়্যার, যা কম্পিউটারে টাইপ করা বাংলা অক্ষর প্রসেস করতে পারবে, এবং এমন ফন্ট, যা স্ক্রিনে বাংলা লেখাকে যথাযথভাবে প্রদর্শন করবে।
এসময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও, শহীদলিপিই ছিল প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা কম্পিউটিং ব্যবস্থা এবং বাংলা ভাষার ডিজিটাল রূপান্তরের পথিকৃৎ।
সাইফ শহীদ ১৯৮৩ সালে বাংলা কম্পিউটিং নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৮৫ সালে ম্যাকিনটোশের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত শহীদলিপি প্রকাশ করেন। তিনি বাংলা লেখার জন্য নতুন একটি কিবোর্ড লেআউট তৈরি করেন, যা ছিল মুনীর চৌধুরীর টাইপরাইটার লেআউটের চেয়ে ভিন্ন।

শহীদলিপির নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, প্রচলিত বাংলা টাইপরাইটার কিবোর্ডের পরিবর্তে কোয়ারটি কিবোর্ডের সঙ্গে মিল রেখে নতুন লেআউট তৈরি করা হয়েছিল, যাতে ইংরেজি কিবোর্ডে অভ্যস্তরা সহজে বাংলা টাইপ করতে পারেন।
সাইফ শাহিদ ও তার দল বেক্সিমকো কম্পিউটার্স লিমিটেড থেকে যশোর, ঢাকা, ফরিদপুর, ভোলা, লালমনিরহাট, মেহেরপুর, জয়পুরহাট, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বেশ কিছু ট্রু-টাইপ ও স্ক্রিন ফন্ট তৈরি করেন। পরবর্তীতে বাজারে আসা অনেক ফন্টেই এসবের প্রভাব দেখা গেছে।
শুধু ফন্ট নয়, শহীদলিপি অপারেটিং সিস্টেমের পুরো ইন্টারফেস বাংলায় রূপান্তর করেছিল, মেনু ও সতর্কবার্তাগুলোও বাংলায় দেখানো হতো। এটি এমন একসময় করা হয়, যখন বাজারে কোনো আনুষ্ঠানিক স্থানীয়করণ সফটওয়্যার ছিল না।
৯০-এর দশকের শেষ দিকে বিজয়, প্রশিকা-শব্দ ও প্রবর্তনসহ বেশ কিছু বাংলা সফটওয়্যার বাজারে আসে। তবে এসবের অনেকগুলোর কিবোর্ড লেআউট গবেষণার দিক থেকে ততটা উন্নত ছিল না।
সময়ের সঙ্গে বিজয় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, ফলে শহীদলিপির ব্যবহার কমতে থাকে। এরপর ২০০৩ সালে অভ্র বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার হিসেবে বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে।
বিজয়ের নির্মাতা মোস্তাফা জব্বারও স্বীকার করেছেন, বাংলা কম্পিউটিংয়ে সাইফ শহীদ পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, 'প্রযুক্তিতে বাংলা যতদিন থাকবে, ততদিন সাইফ শহীদ স্মরণীয় থাকবেন। বাংলা কম্পিউটিংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার হাত ধরেই।'
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন