গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই শিক্ষা প্রশাসনে অস্থিরতা। শীর্ষপদে থাকা আওয়ামী লীগপন্থিদের সরিয়ে দেওয়ার পর বেশিরভাগ জায়গায় চলতি বা রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্তদের দিয়ে চলছে কার্যক্রম। সম্প্রতি রুটিন বা চলতি দায়িত্বে থাকা অনেকে অবসরে চলে যাওয়ায় শিক্ষা প্রশাসনে নতুন করে শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া চলতি মাসের মধ্যে আরও বেশ কয়েকটি পদ ফাঁকা হবে। এতে কার্যক্রমে আরও স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা প্রশাসনের শূন্যপদগুলোতে নিয়োগ পেতে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের দপ্তর ফেলে শীর্ষপদ বাগিয়ে নিতে দিনভর সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ধরনা দিচ্ছেন। অনেকে রাজনৈতিকভাবেও তদবিরে ব্যস্ত। ফলে নিজেদের বিভাগের দায়িত্বটুকুও ঠিকঠাক পালন করছেন না তারা।
মাউশির ডিজিসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩ পদ শূন্য :
শিক্ষা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত শিক্ষা ভবন এখন অভিভাবকশূন্য। গত ১৬ দিন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (ডিজি) পদটি শূন্য। অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদ কলেজ ও প্রশাসন এবং অর্থ ও ক্রয় উইংয়ের পরিচালক পদও ফাঁকা।
বেশ কয়েকটি দপ্তরে গিয়েও দপ্তরপ্রধানের দেখা মেলেনি। কাজ ফেলে সবার দৌড় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কেউ ডিজি পদে, কেউ বোর্ড চেয়ারম্যান পদ, কেউবা আবার প্রধান প্রকৌশলী হতে জোর তদবিরে ব্যস্ত।
জানা গেছে, গত ২ জানুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যান মাউশির মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম। এরপর থেকে পদটি শূন্য। বিতর্কিত কর্মকর্তা এ কিউ এম শফিউল আজমকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়ায় শিক্ষা প্রশাসনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ফলে তিনি কিছুই সামাল দিতে পারছেন না।
এদিকে, কলেজ ও প্রশাসন উইংয়ের পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক রেজাউল করীম। তাকে মাউশির ডিজির চলতি দায়িত্ব দেওয়ায় এ পদটি কার্যত শূন্য ছিল। তবে রেজাউল করীম পিআরএলে যাওয়ায় তা পুরোপুরি ফাঁকা। তাছাড়া ক্রয় ও অর্থ উইংয়ের পরিচালক পদও একমাস ধরে শূন্য।
চেয়ারম্যানশূন্য ঢাকা শিক্ষাবোর্ড :
এপ্রিলের শুরুতে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। এরপর এইচএসসি পরীক্ষা। শিক্ষা বোর্ডগুলো প্রস্তুতির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদটি শূন্য। সাধারণত ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মোর্চা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি হন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ পদটি শূন্য থাকায় কার্যক্রমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, গত ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে অবমুক্ত হয়ে মাউশিতে ফেরেন ঢাকা বোর্ডের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। এরপর তিনি ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে যান। তারপর থেকে চেয়ারম্যানের পদটি শূন্য।
শিক্ষা প্রকৌশলে প্রধান প্রকৌশলী পদও শূন্য :
শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরগুলোর মধ্যে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইডি) অন্যতম। এ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন চৌধুরী অবসরে যাচ্ছেন কাল রোববার (১৯ জানুয়ারি)। ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় কার্যত বৃহস্পতিবারই (১৬ জানুয়ারি) তিনি সবশেষ অফিস করেন। ফলে রোববার থেকে শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান প্রকৌশলী পদটি শূন্য হয়ে পড়বে।
গত সপ্তাহে দুদিন এসেছিলাম। তার আগের সপ্তাহেও এসেছিলাম। কাজ হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। তারা সকালে এসে দপ্তরে ১০ মিনিট বসেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে যাচ্ছেন। কাজ শেষ না করেই ফিরতে হচ্ছে।- স্কুলশিক্ষক ছানোয়ার হোসেন
এরই মধ্যে শিক্ষাখাতের সব অবকাঠামো নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হতে দৌড়ঝাঁপ করছেন অন্তত সাতজন প্রকৌশলী। তাদের প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতা। এখন ভোল পাল্টে কেউ জাতীয়তাবাদী আবার কেউ ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সেজে পদ বাগানোর চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যানও বিদায়ের পথে :
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৎকালীন চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন। সেখানে নিয়োগ পান এনসিটিবির সাবেক সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান।
দেরিতে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু করায় শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেওয়া নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় তিনি। চেয়েছিলেন জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে বিদায় নেবেন। তবে তার আগেই অবসরে যেতে হচ্ছে তাকে। আগামী ২৬ জানুয়ারি শেষ কর্মদিবস রিয়াজুল হাসানের।
ফলে আগামী সপ্তাহের শেষে শিক্ষা প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির শীর্ষ পদও শূন্য হয়ে পড়বে। প্রতি বছর বই ছাপানোর কারণে কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ করে এনসিটিবি। ফলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদে বসতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন শিক্ষা ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ভিড়, দপ্তর ফাঁকা :
শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এমনিতেই নানা ছুঁতোয় বেশিরভাগ সময় নিজ দপ্তর ফেলে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বসে থাকেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ। মাউশির ডিজি, কলেজ ও প্রশাসন উইং এবং অর্থ ও ক্রয় উইংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিতে নিজেদের রুটিন কাজ ফেলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দিনভর মন্ত্রণালয়ে ভিড় করছেন বলে জানা যায়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আস্থাযোগ্য কর্মকর্তার সংকট রয়েছে। যারা সিনিয়র অফিসার…পদগুলোতে আসার কথা; তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।- অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, মাউশির ডিজি পদের দৌঁড়ে এগিয়ে রয়েছেন মাধ্যমিক উইংয়ের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল। তিনি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী হয়েছেন তিনি।
গত সপ্তাহে তিনদিন ১৪, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি দুপুরের দিকে মাউশির মাধ্যমিকের পরিচালকের কক্ষে গিয়ে তার দেখা মেলেনি। অধস্তন কর্মকর্তারা জানান, তিনি সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়েছেন। কেন বা কী কাজে, তা-ও কেউ বলতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে জানতে তার মোবাইল ফোন নম্বরে কয়েক দফা কল করা হলেও রিসিভ করেননি।
শুধু মাধ্যমিকের পরিচালক নয়, আরও বেশ কয়েকটি দপ্তরে গিয়েও দপ্তরপ্রধানের দেখা মেলেনি। কাজ ফেলে সবার দৌড় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কেউ ডিজি পদে, কেউ বোর্ড চেয়ারম্যান পদ, কেউবা আবার প্রধান প্রকৌশলী হতে জোর তদবিরে ব্যস্ত।
মাউশির মাধ্যমিক বিভাগে অফিসিয়াল কাজে গত সপ্তাহে দুদিন শিক্ষা ভবনে ঘুরছেন ভোলা থেকে আসা স্কুলশিক্ষক ছানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে দুদিন এসেছিলাম। তার আগের সপ্তাহেও এসেছিলাম। কাজ হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। তারা সকালে এসে দপ্তরে ১০ মিনিট বসেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে যাচ্ছেন। কাজ শেষ না করেই ফিরতে হচ্ছে।’
শিক্ষা প্রশাসনের এসব শূন্য পদে কবে স্থায়ীভাবে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতে পারে, তা নিয়ে জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা) অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আস্থাযোগ্য কর্মকর্তার সংকট রয়েছে। যারা সিনিয়র অফিসার…পদগুলোতে আসার কথা; তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।’
আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক সময় জানাশোনা না থাকা বা তথ্য ঘাটতি যা-ই বলেন, সেসব কারণে অনেক দুর্নীতিবাজ ও বিগত স্বৈরশাসকের সুরে সুর মেলানো অনেকে চলে আসছেন। পরে তা নিয়ে অনেক ঝামেলা হচ্ছে। এজন্য আমরা সময় নিয়ে যাচাই করছি। আশা করছি, শিগগির শূন্যতা পূরণ হয়ে যাবে।’
Chief Editor: Saidur Rahman Rimon
Acting Editor: Neamul Hassan Neaz
Office: +8809611584881, 01320950171
E-mail: newsnbb365@gmail.com
Copyright © 2025 NBB. All rights reserved.