বিশ্বের ৭০ ভাগ দেশে সাংবাদিকতার পরিবেশকে “খারাপ” বলে বর্ণনা করেছে। আরএসএফ বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, ”বরাবরের মতো” মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে সংকটজনক পরিবেশ হলো এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। এখানকার অর্ধেকেরও বেশি দেশ সবচেয়ে খারাপ রেটিং পেয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম, টেলিভিশন ও রেডিও স্কুলের শিক্ষক ও ব্রডকাস্টার আন্দ্রেয়া হো ১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে তিনজন সাংবাদিককে নিয়ে একটি প্যানেল সঞ্চালনা করেন। পুরস্কারজয়ী এই তিন সাংবাদিক তাদের যুগান্তকারী অনুসন্ধানের মাধ্যমে এশিয়ায় সেই সব কর্তৃত্ববাদী সরকারের কর্মকাণ্ডকে সামনে এনেছে, যারা সত্য উন্মোচন থেকে বিরত রাখতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনলাইনে অপপ্রচার থেকে শুরু করে কারাগারে পাঠিয়ে মুখ বন্ধ রাখা পর্যন্ত নানা রকমের চেষ্টা চালিয়ে থাকে।
ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বড় রেডিও নিউজ এজেন্সি, কেবিআরের সিত্রা প্রস্তুতি ও তাঁর দল জানতে চেয়েছিল, আইন থাকা সত্ত্বেও কেন ইন্দোনেশিয়ায় নিষিদ্ধ বাল্যবিবাহ টিকে আছে। উত্তর পেতে, ইন্দোনেশিয়ায় বাল্যবধূদের নিয়ে ‘দ্বিপক্ষ কাবিন’ (জোর করে বিয়ে) নামে একটি ছয় পর্বের পডকাস্ট সিরিজ তৈরি করে কেবিআর।
ইন্দোনেশিয়ার শ্রোতা, যারা সাধারণত হরর গল্প বা কমেডি পডকাস্ট শোনেন, তারা সিরিজটি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেন। প্রস্তুতি বলেন, পডকাস্ট হিসাবে আমাদের অনুসন্ধানী গল্পটি ছিল শ্রোতাদের কাছে নতুন কিছু।
ফরম্যাট অনুসারে পডকাস্ট হচ্ছে এমন একটি অন্তরঙ্গ মাধ্যম যা শ্রোতার কল্পনা ও আবেগকে অডিওর শক্তির মাধ্যমে ধারণ করে। এ বৈশিষ্ট্য পডকাস্টকে লিঙ্গ ও যৌনতার মতো সংবেদনশীল সাংস্কৃতিক ট্যাবু সম্পর্কে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম হিসাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আদর্শ করে তোলে।
গত বছর ইন্দোনেশিয়ায় বিয়ে বর্হিভূত যৌনতা এবং অবিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে সহবাস নিষিদ্ধ করা হয়।
তাইওয়ানের গণমাধ্যম দ্য রিপোর্টারের প্রধান সম্পাদক শেরি সু-লি লী বলেন, তাইওয়ানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও রাজনৈতিক গুরুত্ব, একে চীনের চলমান ঘটনাবলী এবং অন্যান্য অঞ্চলের ওপর তার প্রভাবকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেয়।
কিন্তু চীন, গণমাধ্যমের ওপর তার চাপ বাড়িয়েই চলেছে। দেশটিতে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি চলছে। তাদের নথি, ভিসা এবং প্রবেশাধিকার অবরুদ্ধ। সোর্সদের ভয় দেখানো হচ্ছে।
এরপরও, দ্য রিপোর্টার যুগান্তকারী সব অনুসন্ধান প্রকাশ করেছে, যা মাদক থেকে শুরু করে মাছ ধরা জেলে ও গলদা চিংড়ির মতো যেকোনো কিছু চোরাচালান ও পাচারের আন্তঃদেশীয় রুটকে পাঠকদের সামনে এনেছে। তাদের প্রতিবেদন অপতথ্য ছড়ানোর নেটওয়ার্ক ও তার নেপথ্যের কারিগরদের প্রচেষ্টাকে ভেস্তে দিয়েছে এবং হংকংয়ে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির জন্য তাইওয়ানের সাগর থেকে বালি চুরি করার ঘটনা উন্মোচন করেছে।
“এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কত কিছু যে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এবং… চীন সবসময় এখানে একটি বড় বিষয়। অন্য কথায়, যখন আমরা এশিয়া নিয়ে অনুসন্ধানের কথা বলি, তখন চীনকে এড়িয়ে যেতে পারি না,” বলেন লী।
মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে রুখতে সরকারের চাপিয়ে দেওয়া “রুদ্ধ সীমান্ত” পেরুতে হলে এবং ভূখণ্ডের সীমা ছাড়িয়ে কাজ করতে হলে সাংবাদিকদের সৃজনশীল ও জোটবদ্ধ হতে হবে।
অ্যালিসন কিলিং, মেঘা রাজাগোপালান এবং ক্রিস্টো বুশেক, তাদের অনুসন্ধানী ধারাবাহিকের জন্য ২০২১ সালে পুলিৎজার পুরস্কার জেতেন। এই ধারাবাহিকে স্যাটেলাইট ছবি ও সাবেক বন্দীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জিনজিয়াংয়ে চীন সরকারের বিশাল বন্দিশিবিরগুলো সনাক্ত করা হয়, যেখানে উইঘুরসহ চীনের অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গণ আটকের পর বন্দী করে রাখা হয়।
লাইসেন্সধারী স্থপতি হিসেবে কিলিং-ই এই পেশার প্রথম ব্যক্তি যিনি পুলিৎজার জিতেছেন। তিনি ২০০৬ সাল থেকে তোলা হাজার হাজার গিগাবাইট স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করেন, এগুলোকে অন্যান্য ওপেন সোর্স ডকুমেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন এবং জিনজিয়াং শিবিরের সাবেক বন্দীদের সঙ্গে কথা বলেন। এভাবে তিনি বন্দীশিবিরের ডিজিটাল প্রতিরূপ তৈরি করেন এবং এটির উদ্দেশ্য ও বন্দীদের সংখ্যা বুঝতে চেষ্টা করেন।
অ্যালিসন কিলিং ও তার দল, পুলিৎজারজয়ী প্রতিবেদনটির জন্য চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর বন্দিশিবিরের হাজার হাজার গিগাবাইট স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। ছবি: ভিক্টোরিয়া গ্রুকা, জিআইজেএন।
বিস্তারিত এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিবেদনে উইঘুর এবং অন্যান্য জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে “গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের” জন্য চীনকে দায়ী বলে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও, জোরপূর্বক শ্রম চর্চার অভিযোগে জিনজিয়াংয়ে তৈরি সমস্ত পণ্যের আমদানি বন্ধ করে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
লী এবং কিলিং উভয়ই দূরবর্তী ভূখণ্ড নিয়ে তাদের নিজ নিজ অনুসন্ধান-কৌশল তুলে ধরেন। বাড়তি হিসেবে কিলিং ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে উন্মুক্ত অনলাইন সোর্স ব্যবহার করে “যেসব জায়গায় যেতে পারবেন না, সেসব জায়গা নিয়ে অনুসন্ধান করতে হয়।”
১. ছোট থেকে শুরু করুন। ছোটখাটো অনিয়ম ও বিচ্যুতি বড় ঘটনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাইওয়ানের দুটি ছোট দ্বীপ থেকে উড়ে আসা অস্ট্রেলিয় গলদা চিংড়ি ভর্তি কার্গো প্লেন অস্ট্রেলিয়া ও চীনের মধ্যকার ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের গলদা চিংড়ি চোরাচালান চক্রের ঢাকনা খুলে দিয়েছিল।
২. দর্শকদের সম্পৃক্ত করতে আপনার গল্পকে ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপন করুন। হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় রানওয়ে তৈরির জন্য তাইওয়ানের সৈকত থেকে বালি চুরি নিয়ে দ্য রিপোর্টারের অনুসন্ধানে অবৈধভাবে সমুদ্রের বালি ড্রেজিং করা চীনা নৌযানগুলোর চলাচলের পথকে ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপন করা হয়।
৩.সরকারি বিজ্ঞপ্তি পড়ুন। কেন্দ্রীয় হিটিং সিস্টেম তৈরির জন্য সরকারের আহ্বান করা দরপত্র এবং তার বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা ঠিকানা, কিলিংকে জিনজিয়াং ক্যাম্পের অবস্থান সনাক্ত করতে সাহায্য করেছে। এর সাহায্যে তারা বন্দীশিবিরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অন্যান্য প্রতিবেদনও খুঁজে বের করেছেন।
৪. ওপেন সোর্স ডকুমেন্ট একত্রিত করার সক্ষমতাকে বহুগুণ করুন। কিলিং জিনজিয়াংয়ের বন্দী শিবিরের অবস্থান নির্ধারণ করতে গুগল আর্থ ও ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির স্যাটেলাইট চিত্রের সঙ্গে বাইদুতে (চীনের গুগল আর্থের সমতুল্য) মুছে দেওয়া ছবি মিলিয়ে দেখেন।
৫.“নিরপেক্ষ” সোর্স হিসাবে স্যাটেলাইট ছবি ঘেঁটে দেখুন। কিলিংয়ের অনুসন্ধানে, ওপেন সোর্স স্যাটেলাইট ছবিগুলো তথ্যের প্রধান উৎস ছিল। এসব ছবি চীন সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, কেননা স্যাটেলাইট ছবিগুলো মার্কিন ও ইউরোপীয় সংস্থার মালিকানাধীন।
প্যানলের উপস্থাপক হো, তাঁর উপসংহারে বলেন: “নিছক একটি প্রতিবেদন সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এটি হয়তো স্বল্প সময়ের জন্য একটি সমাধান দেয়, তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন সবসময়ের জন্য।”
লী-ও একমত। “আমরা বলি ভালো সাংবাদিকেরা এজেন্ডা ঠিক করেন। কিন্তু আমি মনে করি একজন ভালো সাংবাদিককে এজেন্ডা ধরেও রাখতে হয়,” তিনি বলেন। “স্টোরির পেছনে ছুটতে থাকুন, যেন মানুষ বুঝতে পারে আপনি তা ভুলে যাননি।”