প্রিন্ট এর তারিখঃ মে ২৩, ২০২৫, ২:০৭ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ মার্চ ৬, ২০২৫, ৯:৩৩ এ.এম
৬০ গম্বুজ মসজিদ, জানান দেয় ইসলামের সোনালী সময়ের
দেশের তিনটি ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারকের মধ্যে একটি বাগেরহাটের ৬০ গম্বুজ মসজিদ। সম্রাট ফিরোজ শাহ তুগলোকের আমলে সেনাপতি ও ইসলাম প্রচারক হযরত খানজাহান আলী (র.) সাম্রাজ্য বিস্তার ও ইসলাম ধর্ম প্রচারে নির্দেশিত হয়ে বাগেরহাট অঞ্চলে আসেন। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পায় এই মসজিদ।
জানা যায়, ইসলাম ধর্মের প্রচারক সেনাপতি হযরত খানজাহান আলী (র.) সাড়ে ৬শ’ বছর আগে খলিফাতাবাদ রাজ্যের রাজধানীতে মসজিদটি নির্মাণ করেন।
তবে ঐতিহাসিক গবেষক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে ১১৪০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের প্রাচীন আমলের মসজিদগুলোর মধ্যে এটি সর্ববৃহৎ।
কালো পাথর খণ্ডদিয়ে ৬০টি পিলারের ওপর তৈরি এই মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার। এছাড়া ৬০ গম্বুজসহ মসজিদটিতে সর্বমোট ৮১টি গম্বুজ রয়েছে।
যেভাবে এলো ৬০ গম্বুজ নাম
পোড়ামাটির সরু ইট দিয়ে মসজিটি তৈরি করা হয়েছে। তবে ৮১ গম্বুজের এই মসজিদের নাম কী করে ৬০ গম্বজ হল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে সংস্কৃত শব্দ “সাত” ও ফরাসি শব্দ “ছাদ” এর ওপরে গম্বুজ থাকায় এটি “ছাদ গম্বুজ’ থেকে ষাট গম্বুজ হয়েছে।
আবার অন্যরা বলছেন মসজিদ অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে ১০টি করে সর্বমোট ৬০টি পিলারের ওপর মসজিদটি নির্মিত বলে নাম হয়েছে ষাট গম্বুজ।
মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখতে এখনো প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় জমান।
বাগেরহাটের হযরত খান জাহান আলী (র.)–র দরগাহ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে সুন্দরগোনা গ্রামে মসজিদটির অবস্থান। লাল পোড়ামাটির ওপর লতাপাতার অলঙ্করণে এর স্থাপত্য মোড়ানো। এর শৈল্পিক সৌন্দর্য মসজিদটিকে বিশেষ স্থান দিয়েছে।
যে কারণে তৈরি হয় ৬০ গম্বুজ মসজিদ
খানজাহানের বিশাল সৈন্যবাহিনীসহ মানুষের জন্য সুপেয় পানি ও নামাজ আদায়ের সুবিধায় ৩৬০টি বিশাল বিশাল দীঘি ও ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদের মধ্যে ৬০ গম্বুজ মসজিদ সর্ববৃহৎ। এর পশ্চিম পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক ঘোড়া দীঘি। পূর্ব-উত্তর কোণে রয়েছে কোদাল ধোয়া দীঘি। ৬০ গম্বুজের দৈর্ঘ্য ১৫৯ ফুট ৮ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০৮ ফুট ৬ ইঞ্চি। মসজিদের ভেতরের আয়তন লম্বায় ১৪৩ ফুট ৩ ইঞ্চি, প্রস্থ ৮৮ ফুট ৬ ইঞ্চি। মেঝে থেকে ১৩ ফুট ওপরে ওঠার পর ৬০টি পিলারের ওপর ৭৭টি গম্বুজ ও চার কোণে চারটি মিনার গম্বুজের দেখা মিলে।
এই চার মিনার গম্বুজের পূর্বদিকে দুটি গম্বুজের মধ্যে দিয়ে তৈরি স্থায়ী পেচানো সিঁড়িপথ রয়েছে। এর একটিকে বলা হয় রওশন কোঠা, অপরটিকে বলা হয় আন্ধার কোঠা। আগে এই দুটি কোঠা আজান দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো।
মেঝে থেকে ১৩ ফুট ওপরে ওঠার পর ৬০টি পিলারের ওপর ৭৭টি গম্বুজ ও চার কোণে চারটি মিনার গম্বুজের দেখা মিলে।
মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি প্রবেশপথ রয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় দরজা ৯ ফুট ৭ ইঞ্চি প্রস্থ। অন্য দরজাগুলো ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি পর্যন্ত প্রশস্ত। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে সাতটি করে মোট ১৪টি দরজা রয়েছে। এসব দরজা বাইরের দিক থেকে ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি ও ভিতরের দিক থেকে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি প্রশস্ত।
রমজান মাসে কেমন থাকে ৬০ গম্বুজের পরিবেশ
প্রতি বছর রমজান মাসে মসজিদটিতে খতম তারাবিহ আদায় করা হয়। এছাড়া পাঁচ শতাধিক মুসল্লি ইফতারেও অংশ নেন। দেশি- বিদেশি পর্যটকরা সরকার নির্ধারিত দামে টিকিট কেটে মসজিদটি ঘুরে দেখতে পারেন। তবে মসজিদটিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কোনো টিকিট ছাড়াই ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার সুযোগ পান। মুসলমানদের মিলন মেলায় পরিণত হয় শুক্রবার।
নারীদের নামাজের আলাদা জায়গা
মসজিদের উত্তর পাশের একটা অংশে কাপড় দিয়ে ঘেরা দিয়ে নারীদের জন্য নামাজের আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দেশ বিদেশের নারীরা ওয়াক্ত ও নফল নামাজ আদায় করেন। এছাড়া তারাবির নামাজেও অংশ নিতে পারেন তারা।
মসজিদের গায়ে খোদাই করা শৈল্পিক সব কাজ ইসলামের সোনালী সময়ের জানান দেয়।
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য
বাংলাদেশে নির্মিত প্রাচীন আমলের মসজিদগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ এটি। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন এ মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্টেইজ’ অংশ হিসেবে মর্যাদা দেয়। মসজিদটি বাগেরহাট শহরকে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহরের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে।
সহযোগিতা ইমাম ও খতিব
বর্তমানে ৬০ গম্বুজ মসজিদে ভারপ্রাপ্ত ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন মো. নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৫ ফেরুয়ারি ইমাম হেলাল উদ্দিন মাতুব্বর মারা যাওয়ার পর থেকে আমি দায়িত্ব পালন করছি। মসজিদে দুইজন হাফেজ প্রতি রমজানে খতমে তারাবিহ নামাজ পড়ান। পাশাপাশি রমজানের ৩০ দিন ইফতারের ব্যবস্থাও থাকে। স্থানীয় ও দর্শনার্থীরা মিলে ৪ শতাধিক রোজাদার প্রতিদিন ইফতারে অংশ নেন।
ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের পাশাপাশি নিয়মিত স্থানীয় তিন শতাধিক মুসল্লি ৬০ গম্বুজ মসজিদে নামাজ আদায় করেন।
স্থানীয় মুসল্লি শেখ মনজুরুল হক রাহাদ বলেন, `পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ (খানজাহান আলী (র.) নামে বেশি পরিচিত) মসজিদটি নির্মাণ করেন। খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের পাশে অবস্থান হওয়ায় অনেকেই নামাজ পড়তে আসেন। খানজাহানের দরগাহ থেকে মসজিদটির দূরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। আকৃতির বিচারে বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত মধ্যযুগীয় মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ৬০ গম্বুজ মসজিদ। মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখতে এখনো প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় জমান।'
৬০ গম্বুজ মসজিদ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাস্টডিয়ান মো. যায়েদ বলেন , মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধন ও সংস্কারের সবকিছু প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নির্দেশনায় করা হয়। এই বছরেও সংস্কার কাজ করা হয়েছে। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে নিশ্চিতভাবে ধারণা করা হয় এটি খান-ই-জাহানের নির্মিত। প্রতি বছর মসজিদটি দেখতে লাখো দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ভিড় করেন। এ থেকে সরকার প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব পায় বলেও জানান তিনি।