• শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ০৪:১৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম

চারতলা ভাড়া বাড়িতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; সরকারের ৩৫৯ কোটি টাকা গচ্চা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
Update : রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২৫

কয়েক বছর পরও চারতলা বাড়িতে ভাড়ায় চলছে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। চারতলা বাড়িটিতে নেই মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ, আধুনিক ল্যাব বা সমৃদ্ধ লাইব্রেরি।

যেখানে স্থায়ী ক্যাম্পাসই নেই সেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের আবাসনের দাবি তোলারও সুযোগ পাচ্ছেন না। তাই বিভিন্ন বাসাবাড়িতে মেস ভাড়া করে দুর্বিষহ সময় পার করছেন তারা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের এ দুর্দশার জন্য দায়ী তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, তার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপু এবং তাদের দোসররা। জমি নিয়ে তাদের দুর্নীতির কারণেই বাতিল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ।

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পেয়ার আহমেদ বলেন, “বর্তমানে শহরের খলিশডুলি এলাকায় যে অস্থায়ী ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু আছে, তাতে একটি কিন্ডারগার্টেনও চলবে না। ফলে যত দ্রুত সম্ভব আমরা স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান উন্নয়নে আধুনিক ল্যাব স্থাপন, লাইব্রেরি বর্ধিতকরণ, গবেষণা সেল গঠন, আইকিউএসি সেল গঠনসহ যুগোপযোগী চাহিদা সম্পন্ন নতুন বিভাগ চালু করা প্রয়োজন।

শিক্ষার্থীরা আরও জানান, নিজেদের হল না থাকায় এবং ভাড়া করা ভবনের আশেপাশে ভালো কোনো খাবার হোটেল বা ক্যান্টিন না থাকায় তাদের খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য মেডিকেল সেন্টারও নেই।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস ছাড়া এসব কিছুই সম্ভব হবে না। তাই অবিলম্বে স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের দাবি তাদের।

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খসড়া আইন মন্ত্রিসভা থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর। পরের বছর ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘চাঁদপুর’ পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণের অনুমতি মেলে ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল। কিন্তু তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজন নিজেদের নামে জমি কিনে ২০২০ সালের ১৮ মে থেকে ২০২১ সালের ১৫ মে পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ঠিক সেই জায়গা নির্ধারণ করে অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসককে চাপ দেয়।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চাঁদপুর সদর উপজেলায় ৬২ দশমিক ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব পাওয়া যায়। সেই জমির মৌজা রেট অনুযায়ী দাম ছিল ১৯৪ কোটি টাকা।

কিন্তু একটি চক্র মৌজার রেট পরিবর্তন করে অতিরিক্ত দামে দলিল করে। যার দাম দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। বিষয়টি সন্দেহজনক হলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ভূমি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ফলে মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দল সরেজমিন তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে ভূমি অধিগ্রহণে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির সমূহ সম্ভাবনার প্রমাণ পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রস্তাবিত ভূমির অনুমোদন বাতিল করে দেয়।

সরকারের গচ্চা যেত ৩৫৯ কোটি টাকা

অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত ভূমি নিয়ে জালিয়াতির তথ্য জানাজানি হয়ে গেলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চাঁদপুর সদর উপজেলার ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার ৬২ দশমিক ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয়।

এর ফলে জমির দাগ সূচি চূড়ান্তকরণ করে অধিগ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব পায় জেলা প্রশাসন। তবে জমিগুলো জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটি নির্বাচন করেনি। এই জমির প্রস্তাব দিয়েছে সরাসরি প্রত্যাশী সংস্থা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই মৌজার সাব রেজিস্ট্রি অফিসের বাজার মূল্য অনুযায়ী নাল শ্রেণির প্রতি শতক জমির দাম ১৩ হাজার ৮০২ টাকা। বিভিন্ন শ্রেণির ভূমির জন্য সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষিত সর্বশেষ ২০১৬ সালের নির্ধারিত মৌজার তুলনায় অধিগ্রহণের জন্য সংগৃহীত মূল্য হার অস্বাভাবিক বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটি নির্ধারিত মৌজার জমি বেচাকেনার দলিল পর্যালোচনা করে ১৩৯টি দলিল পেয়েছে। যেগুলো অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। তাও আবার এক বছরের মধ্যে।

জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা বলছে, প্রস্তাবিত জায়গায় মৌজা দরে ৬২.৫০ একর জমির দাম হয় ১৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু হঠাৎ উচ্চমূল্য দেখিয়ে যেসব দলিল করা হয়েছে, সেটা আমলে নিলে সরকারের ৫৫৩ কোটি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সরকারকে অতিরিক্ত দিতে হত ৩৫৯ কোটি টাকা।

টাকা দেওয়া হয়নি অধিকাংশ জমির মালিককে

জেলা প্রশাসকের এল এ শাখা থেকে জানা যায়, ৬২ দশমিক ৫০ একর জমির মধ্যে অধিকাংশই প্রয়াত সেলিম খান ও তার স্বজনদের নামে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর ভাই ওয়াদুদ টিপুর নামে রয়েছে ৬ দশমিক ৬৮ একর জমি। বাকি জমি সাবেক মন্ত্রীর রাজনৈতিক নেতাদের নামে দলিল করা আছে বলে উল্লেখ রয়েছে। ওই জমি সরকার বন্দোবস্ত দেয়নি।

তবে গত বছরের ডিসেম্বরে সরেজমিনে এলাকার বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম খান (যাকে গত অগাস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় এলাকাবাসী পিটিয়ে হত্যা করে) এসব জমি মানুষের কাছ থেকে জোর করে দখল করে নিয়েছিলেন।

কিছু কিছু দলিল গ্রহীতাকে স্বল্প পরিমাণ টাকা দিলেও অধিকাংশ জমির মালিককে টাকা দেওয়া হয়নি।

 

ওই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাকির উকিল বলেন, “সেলিম চেয়ারম্যান জায়গার জন্য আমাকে মেরেছে। সবশেষে আমার সকল জমি জোর করে নিয়ে গেছে।”

ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি কাশেম বেপারী বলেন, “আমাকে এবং আমার পরিবারের লোকজনকে মারধর করে ৩ একর ৬৪ শতক জমি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মন্ত্রী নিয়ে গেছে।

“এর মধ্যে ২৭ শতক রেজিস্ট্রি করে টাকা দিয়েছে। বাকি সম্পত্তি, টাকা আজও পাইনি। ওই জায়গা তারা ভরাট করে রেখেছে।”

একই এলাকার মোস্তফা গাজী, মোতালেব গাজী, মুক্তার গাজী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাদের তিন একরের মত জায়গা নিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত একটি টাকাও পাননি তারা।

ওই এলাকার পগার গাজী বলেন, “ভিটে-মাটিসহ আমাদের ৫৩ শতক জমি জোর করে নিয়ে গেছে। কত কান্নাকাটি করেছি কোনো লাভ হয়নি। এক পর্যায়ে আমাদেরকে অন্য একটি জায়গায় থাকতে দিয়েছে। সে জায়গাটিও অন্যের। এখন ওরা আমাদেরকে সরে যেতে বারবার তাগিদ দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা কী করব জানি না।”

একই সমস্যার কথা জানালেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মান্নান গাজীও।

এলাকাবাসীর দাবি, প্রস্তাবিত জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় না হলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের জমি টাকা ফেরত দেওয়া হোক। এ ব্যাপারে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।

নতুন জায়গা খুঁজছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক পেয়ার আহম্মদ বলেন, “আগে কী হয়েছে আমি জানি না। আর সেটি জানতেও চাই না। তবে স্থায়ী ক্যাম্পাসের ভূমি অধিগ্রহণের আমরা নতুন জায়গা খুঁজছি।

“বিভিন্ন স্থানে জায়গা দেখা হচ্ছে। ভূমি পেলে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।”

তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগে ২৭০ জন শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত। আগামীতে আরও তিনটি বিভাগ চালুর লক্ষ্যে অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

চলতি বছর গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিগগির এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে বলে জানান উপাচার্য।

তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথক হল ভাড়া, একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন বর্ধিতকরণ নিমিত্তে ভবন ভাড়া, আধুনিক ল্যাব স্থাপন ও লাইব্রেরি বর্ধিতকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চাঁদপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক রহিম বাদশা বলেন, “শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ী ক্যাম্পাস দীর্ঘদিনের দাবি। তাদের পাঠদান চারতলার একটি ভাড়া বাড়িতে চললেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার মতো মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থীরা এক দুর্বিষহ সময় পার করছেন।”

তিনি বলেন, “দ্রুত স্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গা নির্ধারণ করা গেলে সেখানে শিক্ষার্থীদের যেসব সমস্যা রয়েছে, তা সমাধান করা যাবে।”

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, “আগের প্রস্তাবিত স্থানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে না। আমরা নতুন জায়গা খুঁজছি। তা পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।”

 

 

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের মূখপত্র।। NBB

Acting Editor: Neamul Hassan Neaz

Mofussal Editor: Kamrul Hasan Rony

Office: +8809611584881, 01320950171

E-mail: newsnbb365@gmail.com

Translate »